২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / বিকাল ৪:২৮
২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / বিকাল ৪:২৮

আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়ে রাখলেন মেসি

যার ভেতর নিজের কায়া ও ছায়া খুঁজে পেতেন ম্যারাডোনা,সেই লিওনেল মেসিই তার মুখে ফোটালেন হাসি। সেই সঙ্গে আর্জেন্টিনার মানুষ আর বিশ্বজুড়ে অগণিত আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মুখেও ফোটালেন হাসি। একরকম খেলার ধারার বিপরীতেই মেক্সিকোর বিপক্ষে প্রথম গোলটা করে আর্জেন্টিনা দলের ভেতর জয়ের বিশ্বাসটা তো মেসিই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাসে ভর করেই এল এনজো ফার্নান্দেজের গোল। ২-০ গোলে মেক্সিকোকে হারিয়ে বিশ্বকাপে টিকে রইলো আর্জেন্টিনা, এতে করে যেন স্বস্তিতে বিশ্বকাপের আয়োজকরাও। প্রথম রাউন্ডেই মেসির বিদায় মানে তো বিয়ের আসর থেকে বউ পালিয়ে যাবার মতোই কেলেংকারি!

ম্যারাডোনার সঙ্গে মেক্সিকো নামটা চলে আসে আপনাতেই। ১৯৮৬’র মেক্সিকো বিশ্বকাপেই তো অমরত্বে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। সেই মেক্সিকোর বিপক্ষেইবিশ্বকাপে ম্যাচ এবং গোল সংখ্যায় ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে ছুঁয়ে ফেলার দিনে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখলেন লিওনেল মেসি। বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচে ৮ গোল দুজনেরই। তবে ম্যারাডোনার গোল সংখ্যা আর ম্যাচ সংখ্যা কিছু বাড়ার উপায় নেই। সমর্থকরা চাইবেন মেসি অন্তত এই জায়গাটায় ছাড়িয়ে যান ম্যারাডোনাকেও।

প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হারের ধাক্কা সামলাতে মেক্সিকোর বিপক্ষে একাদশে পাঁচ পরিবর্তন আনেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি। রাইট ব্যাক হিসেবে গনজালো মন্টিয়েল খেলেন নাহুয়েল মলিনার জায়গায়, সেন্টারব্যাক লিসান্দ্রো মার্টিনেজ দলে আসেন ক্রিস্টিয়ান রোমেরোর জায়গায়,লেফটব্যাক মার্কোস আকুইনা খেলেন নিকোলাস তেগলিয়াফিকোর পরিবর্তে,সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার গুইদো রদ্রিগেজকে নেয়া হয় লিয়ান্দ্রো পারাদেসের বদলে আর অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার খেলেন আলেজান্দ্রো গোমেস এর পরিবর্তে।

পাঁচটা পরিবর্তন এনেও প্রথমার্ধে খেলায় খুব একটা ধার বাড়াতে পারেননি স্ক্যালোনি, বরং শুরু থেকে আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগে চড়াও হয়েছে মেক্সিকো। নাপোলিতে খেলা ফরোয়ার্ড হারভিং লুজানো ছিলেন মেক্সিকোর আক্রমণের মধ্যমণি। সঙ্গে অ্যালেক্সিস ভেগা মিলে ব্যাতিব্যস্ত করে রাখেন আর্জেন্টিনার রক্ষণ। প্রথমার্ধে এগিয়ে যাবার বেশ কয়েকটি সুযোগ পেয়েছিল মেক্সিকো। মধ্যবিরতির ঠিক আগে বক্সের বাইরে মন্টিয়েল ফাউল করেন গিতেয়েরেজকে। ২৫ গজ দূর থেকে ভেগার নেয়া দারুণ ফ্রি-কিকটা ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুণভাবে তালুবন্দি করে নেন এমিলিয়েনো মার্টিনেজ। সেটপিসে বেশ কিছু সুযোগ তৈরি করেছিল মেক্সিকো, কিন্তু উপযুক্ত ফিনিশিংয়ের অভাবে মেলেনি গোলের দেখা।

বিরতির পর খেলা শুরুর মিনিট পাঁচেক পর অবশ্য আর্জেন্টিনাও ফ্রি কিক পেয়েছিল প্রায় কাছাকাছি দুরত্বেই, মেসিকে ফাউল করেছিলেন গুতিয়েরেজ। মেসি ফ্রি-কিকটা উড়িয়ে মারেন ক্রসবারের উপর দিয়ে। স্ক্যালোনির কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ডানপ্রান্ত থেকে বেশ কয়েকবারই মেক্সিকোর রক্ষণে ঢোকার চেষ্টা করেছেন এই উইঙ্গার। কিন্তু তার ক্রস খুঁজে পায়নি কাউকে, অথবা আগেই বল ক্লিয়ার করে দিয়েছে মেক্সিকান রক্ষণ। ৫৫ মিনিটে ডি মারিয়া ঢুকে গিয়েছিলেন রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে, সুন্দর করে স্কোয়ার পাস বাড়িয়ে দিয়েছিলেন একদম গোলমুখের সামনে, কিন্তু বাড়িয়ে দেয়া বলে পা ছোঁয়াতে পারেননি ম্যাকঅ্যালিস্টার। মেসি গোল করার আগে সেটাই ছিল আর্জেন্টিনার গোলের সবচেয়ে বড় সুযোগ।

ম্যাচের ৬৪ মিনিটের সময়ে ডি মারিয়া ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণে উঠছেন, ফরোয়ার্ডরা সামনে ছুটছে আর রক্ষণও ভিড় করছে ডি বক্সে। এমন সময় বক্সের বাইরে আশ্চর্যজনকভাবে একেবারে ফাঁকা মেসি, নেই কোনো মার্কার! ডি মারিয়া আড়াআড়ি পাসটা দিলেন মেসিকে, বাম পায়ে বলটা ধরে একটু জায়গা নিয়ে বাম পায়েই গড়ানো কিন্তু জোরালো শট মেসির। খানিকটা কৌণিক। গিলেরমো ওচোয়া ঝাঁপালেন, বল তার হাতের একটু দূর দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে ঠেকলো জালে।

এলোমেলো, ছন্দহীন আর্জেন্টিনাকে ম্যাচে ফেরাতে এমনই এক জাদুকরী মুহূর্ত দরকার ছিল মেসির। যে জাদুর ছোঁয়ায় সিন্ডারেলার মতোই সাধারণ মেয়েটি বদলে যাবে রাজকন্যায়! গোলের দেখা পাবার পর ধার বেড়েছে আর্জেন্টিনার খেলায়। গোল পাবার মিনিট খানেক আগেই। ৫৬ মিনিটে গুইদো রদ্রিগেজকে তুলে এনজো ফার্নান্দেজকে নামান স্ক্যালোনি। ৮৭ মিনিটে সেই এনজো ফার্নান্দেজই গোল করে ভেঙে দেন মেক্সিকানদের অঘটনের স্বপ্ন। মেসির পাসে বক্সের ভেতরে বল পেয়ে গুতিয়েরেসকে কাটিয়ে বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডান পায়ের জোরালো শটে মেক্সিকোর জালে পাঠিয়ে দেন এনজো। বিশ্বকাপে তো বটেই, আর্জেন্টিনার জার্সিতেই এটা এনজোর প্রথম গোল। আর এই গোল তাকে ঠাঁই দিয়েছে ইতিহাসে। লিওনেল মেসির রেকর্ড ভেঙে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মসির পর সবচেয়ে কমবয়সি গোলদাতা হয়ে গেছেন ২১ বছর বয়সি এই ফুটবলার। আর মেসি এখন একই সঙ্গে ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর থেকে সবচেয়ে কমবয়সি গোল এবং অ্যাসিস্ট ও সবচেয়ে বেশি বয়সে গোল ও অ্যাসিস্টের এক বিরল রেকর্ডের মালিক!

বিশ্বকাপ গোল ও ম্যাচ সংখ্যায় ম্যারাডোনাকে ছুঁয়ে ফেললেন মেসি। ফারাক শুধু বিশ্বকাপে।ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাও ১৯৯০ সালে প্রথম ম্যাচে হারের পর উঠেছিল ফাইনালে। এবার কি তাহলে সেই পথেই এগোবে আকাশি-নীলরা? শুধু ফাইনালে কোনো কোডেসাল না থাকলেই পূর্ণতা পাবে রূপকথা, যেটা তিন সপ্তাহ পর হবে এই লুসাইল স্টেডিয়ামেই। বলে রাখা ভাল, ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালের রেফারি কোডেসাল কিন্তু ছিলেন মেক্সিকান!

Facebook
Twitter
LinkedIn