কর্তৃপক্ষের অনিময়, দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র এবং অদক্ষতার কারণে ঢাকা ওয়াসা ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পথে। এমনটি মনে করেন বিশেষজ্ঞরা
তাদের মতে, এসব কারণে একদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বেশি হচ্ছে, অপরদিকে ঘাটতি মেটাতে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে পানির দাম। সংকটের সমাধান চাইলে প্রথমত দুর্নীতির লাগাম টানতেই হবে। এরপর বিদায় দিতে হবে একনায়কতন্ত্র। এ দুটি করা সম্ভব হলে অদক্ষতাসহ বাকি সমস্যাগুলো এমনিতে সমাধান হয়ে যাবে।
জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার বর্তমান প্রশাসন বিগত প্রায় ১৩ বছরে পানির দাম বাড়িয়েছে ১৪ বার। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও দুই বছরে দুদফা আবাসিক ও বাণিজ্যিক পানির দাম বাড়াতে ভুল করেনি সংস্থাটি। তবে প্রতিবছর পানির দাম বাড়লেও ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির গুণগত মান বাড়ছে না। সরবরাহ লাইনের পানি সরাসরি খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কোনো কোনো এলাকার পানি ফুটিয়েও পান করতে পারছেন না নগরবাসী। আরও জানা যায়, এ অবস্থার মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে ফের বাড়ানো হচ্ছে পানির দাম। সোমবারের বোর্ড সভায় নতুন করে পানির দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বোর্ড সদস্য প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। তবে বেশিরভাগ বোর্ড সদস্য এতে বাদ সাধেন। ফলে প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। এরপরও বোর্ড সদস্যদের ওপর চাপ তৈরি করে তিনি এ প্রস্তাব অনুমোদনের চেষ্টা করছেন।
নতুন দাম কার্যকর হলে রাজধানীবাসীকে ইউনিট প্রতি আবাসিক পানির দাম ১৫ টাকা ১৮ পয়সার স্থলে ২১ টাকা গুনতে হবে। বাণিজ্যিক পানির দাম ৪২ টাকার স্থলে হবে ৫৫ টাকা। এক বোর্ড সদস্য যুগান্তরকে জানান, ‘সরকারের উচ্চপর্যায়ের দোহাই দিয়ে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড সদস্যদের এক ধরনের ভয় দেখানো হয়। মূলত এভাবেই ১৪ দফা পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. মো. গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন আইন-১৯৯৬ অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসা বোর্ড প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারবে। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা থেকে এবার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা ৫ শতাংশের বেশি। এ প্রস্তাব অনুমোদন করার ক্ষমতা বোর্ডের নেই।’
তিনি বলেন, ‘সোমবার অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় পানির দাম বাড়ানোর বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বেশিরভাগ সদস্য এর বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। এরপরও মন্ত্রণালয় চাইলে এটা অনুমোদন করে দিতে পারে। তারপরও মন্ত্রণালয় চায় বোর্ড থেকে একটা প্রস্তাব পাঠানোর জন্য। এজন্য বিষয়টি নিয়ে আমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব। এরপর মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক্রমে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম, দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র এবং অদক্ষতার কারণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবা দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাগুলো দূর না করে ব্যর্থতার দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের উচিত এ সংস্থার দুর্বলতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার পানির গুণগত মান খুবই নাজুক। না ফুটিয়ে ট্যাপের পানি পান করা যায় না। এরপরও পানির গুণগন মান উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ নেই। মান বাড়ানোর দিকে মনযোগ না দিয়ে পানির দাম বাড়াতে মরিয়া সংস্থাটি। ঢাকা ওয়াসা প্রশাসন এবং ঢাকা ওয়াসা বোর্ডকে পানির গুণগত মানের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এজন্য তাদের যা কিছু তাই করছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা না করেই তা বাস্তবায়ন করছেন। এতে করে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা মিলছে না। মূলত অনিয়ম, দুর্নীতি এবং লুটপাটের মানসিকতা থেকে তারা এগুলো করছেন।
বাস্তবতা হলো, সবাই মিলেমিশেই এসব করছেন। অথচ দেখার যেন কেউ নেই।’ তিনি বলেন, ‘অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধ করলে পানির দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন হতো না। প্রকল্পগুলো অনেক কম টাকায় বাস্তবায়ন করা যেত। একইভাবে প্রকল্পগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা মিলত। কিন্তু সেদিকে কারও কোনো নজর নেই।’ তিনি মনে করেন, ‘ঢাকা ওয়াসাকে স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থেকে গণমানুষের প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে ব্যর্থ হলে বিদ্যমান সংকট নিরসন করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে ঢাকাবাসীকে আরও সজাগ হতে হবে। তা না হলে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসবে স্বৈরতান্ত্রিক চক্রটি।’
ঢাকা ওয়াসার পানির দাম সবচেয়ে বেশি : বাংলাদেশে ওয়াসার সংখ্যা ৪টি- ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী। এরমধ্যে ঢাকা ওয়াসার আবাসিক ও বাণিজ্যিক পানির দাম সবচেয়ে বেশি। পানির উৎপাদন খরচ কাছাকাছি হলেও পানির দাম বাড়াতে মরিয়া ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ওয়াসাসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম প্রতি ১ হাজার লিটার ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। বাণিজ্যিক পানির দাম ৪২ টাকা। রাজশাহী ওয়াসার আবাসিক পানির দাম ৬ টাকা ৮২ পয়সা এবং বাণিজ্যিক পানির দাম ১৩ টাকা ৬২ পয়সা। খুলনা ওয়াসার আবাসিক পানির দাম ৮ টাকা ৯৮ পয়সা এবং বাণিজ্যিক দাম ১৪ টাকা। চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক পানির দাম ১২ টাকা ৪০ পয়সা। এছাড়া বাণিজ্যিক পানির দাম ৩০ টাকা ৩০ পয়সা।
প্রকল্পের ব্যর্থতার বোঝা গ্রাহকের ঘাড়ে : ঢাকাবাসীর পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা ওয়াসার খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এখান থেকে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা থাকলেও পাচ্ছে মাত্র ১৫ কোটি লিটার। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সরবরাহ লাইনের কথা চিন্তাই করেনি ঢাকা ওয়াসা প্রশাসন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা। মূলত এসব কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের যশলদিয়া এলাকাসংলগ্ন পদ্মা নদীর পার থেকে মিটফোর্ড হাসপাতাল পর্যন্ত ওই প্রকল্পে পানি সরবরাহ লাইন রয়েছে। প্রকল্পভুক্ত এ পাইপলাইনের প্রশস্ততা ২ হাজার মিলিমিটার। মিটফোর্ড থেকে সমপরিমাণ প্রশস্তের সমপরিমাণ পাইপলাইন থাকা দরকার ছিল। কিন্তু আগে থেকে পরিকল্পনা না করায় ৬০০ মিলিমিটার প্রশস্ত পাইপ থেকে ঢাকায় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যে কারণে উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করা হচ্ছে। অথচ ওই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পরিচালনায় ৪৫ কোটি লিটারের জন্য যে পরিমাণ খরচ হতো এখন প্রায় একই পরিমাণ খরচ হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার এ দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের ওপর। সমালোচনা এড়াতে ঢাকা ওয়াসা ওই প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৩০ কোটি লিটার বলছে। যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে অভিমত প্রকৌশলীদের। সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ পাইপলাইন দিয়ে দুই ভাগ পানি উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এটা ব্যর্থতা ডাকার অপকৌশল মাত্র।
এ প্রসঙ্গে মিটফোর্ড থেকে ঢাকায় প্রকল্পের পানি সরবরাহ লাইন নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কেয়া এন্টারপ্রাইজের কিরন মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্পের পাইপের প্রশস্ততা (ডায়া) ২ হাজার মিলিমিটার। কিন্তু সরবরাহ লাইনের ডায়া ৬০০ মিলিমিটার। তিনি আরও বলেন, পদ্মা নদী থেকে মিটফোর্ড হাসপাতাল পর্যন্ত পাইপলাইনের প্রশস্ততা ২ হাজার মিলিমিটার। অথচ মিটফোর্ড থেকে ইংলিশ রোড পর্যন্ত পাইপের প্রশস্ততা ৭০০ থেকে ৭৫০ মিলিমিটার প্রশস্ত। ইংলিশ রোড থেকে ৬০০ মিলিমিটার প্রশস্ততা পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, প্রধান সমস্যা এখানেই। শোধনাগারের পাইপের ডায়া বা প্রশস্তার সঙ্গে মিল রেখে সামগ্রিকভাবে পানি সরবরাহ লাইনের পাইপের প্রশস্ততায় ভারসাম্য রক্ষা করা হয়নি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রাজধানীসংলগ্ন দাশেরকান্দি এলাকায় একটি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পে ভৌত অগ্রগতি ১০০ ভাগ। এ প্রকল্প চালু করতে স্যুয়ারেজ লাগবে। প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ হলেও স্যুয়ারেজ সংগ্রহের কোনো পাইপলাইন স্থাপন করা যায়নি। দুর্নীতির উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে প্রকল্প যাচাই-বাছাই না করে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সেখান থেকেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ব্যর্থ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে বারবার পানির দাম বাড়ানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা জনগণের কথা চিন্তা করছেন না। ঢাকা ওয়াসা কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত না করে ঢাকাবাসীর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে অযাচিত বিলের বোঝা।’