হাসপাতাল ক্লিনিকে শোকের ছায়া। বাতাসে নড়ছে ট্রলিতে সাদা মুখ ঢাকা সাদা কাপড়। কিন্তু মানুষটা নড়ছে না। অসাঢ় !
মার্চ থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত ঢাকার কোন না কোন হাসপাতাল, ক্লিনিকের প্রায়দিনের রোজনামচা এটা … এডিসের মরন কামড়ে আপনজনকে হারিয়ে পুরো শহর যেনো থমথমে। মানুষের ঘরবাড়ি, বাইরে চলাচল, বসবাস, অফিস আদালত, কায় কারবার সবখানেই কেমন যেন একটা ভয় বহনে করে যাচ্ছে ঢাকাবাসী। এই না এডিস এলো। ফুঁত করে বসিয়ে দিলো সুইফোটা মরণ কামড়। আগের মৃত্যুর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ডেঙ্গু । মহামারি আকার ধারণ করেছে। লাশের পর লাশের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ডেঙ্গু নির্মুল তো দূরের কথা। জনজীবনে সবার চিকিৎসার অধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বাস্ব্য মন্ত্রণালয় বনাম ডিএনসিসির চলছে কথার লড়াই ! স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডেঙ্গু মহামারীর জন্য সিটি কর্পোরেশনের গাফিলতাকেই দোষারোপ করছে। আর ডিএনসিসি এই দায় শিকার করছে না। তারা মানুষের অসচেতনাকেই বেশি দায়ী করছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত। ওদিকে ছোট্ট একটি মশার কামড়ে কম হলেও ৫ শতাধিকের বেশি অভাগা ইতিমধ্যেই আপনজনকে কাঁদিয়ে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। আপনজন হারানোর বুকফাটা কান্নার আওয়াজ আমরা সাধারণ মানুষের কানে প্রতিধ্বনিত হলেও, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা বাহিনী নাশ করতে যাদের ১০৫ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, শত শত মানুষের কান্না ও আহাজারি শুধু সেইসব মানুষখেকো মানুষগুলোর কানেই হয়ত পৌঁছাচ্ছে না। টলাতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৩২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকার বিগত অর্থ বছরের বরাদ্দ নেয়ার পেছনের জনসেবকদেরও! এডিসের সুঁইফোটা যন্ত্রণায় প্লাটিলেট শুন্য হয়ে হাসপাতালের আইসিইউর সিরিয়ালের অপেক্ষায় ছটফট করতে করতে চোখ বন্ধ করা মানুষগুলোর নিরব প্রস্থানই সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার ভোগ করতে না পারার যেন ‘নিরব প্রতিবাদ’। যে প্রতিবাদের ভাষা নেই। রঙ নেই। আছে শুধু মৃত্যু যন্ত্রণা … ঢাকার হাসপাতাল, ক্লিনিকে গেলে দেখা যায় ডেঙ্গু রোগী আর রোগীর আত্মীয় পরিজনের কতটা বেহাল অবস্থা। স্ব-চোখে না দেখলে উপলব্ধি হবে না। খুব খারাপ একটা সময়ের আবর্তে মানুষগুলো আজ কতটা অসহায়। কতটা পেরেশান। কারও জ¦র আসলেই একটা কেমন যেন আতঙ্ক নেমে আসছে চোখে মুখে। আর ব্লাড টেস্টে ডেঙ্গু লক্ষণ পাওয়া মাত্রই যেন পৃথিবীটা অন্ধকার। যে যার বলয় থেকে – নেমে পড়ছে ডেঙ্গু চিকিৎসায়। কে কোন হাসপাতাল যাবে, কোথায় ডেঙ্গুর ভালো চিকিৎসা হয়। ভালো সেবা পাওয়া যায়। নিকটজন থেকে এসব তথ্য জানতেও ব্যতিব্যস্ত। প্রাইভেট ক্লিনিকই পছন্দ উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটছেন সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে এত পরিমাণ ডেঙ্গুরোগী। সিট সংকুলান হচ্ছে না। এই সুযোগে সিট নিয়েও চলছে রমরমা বাণিজ্য। অনেকে পয়সায় আবার অনেকে রাজনৈতিক ও হাসপাতালের চেনাজানা আত্মীয়তার সুযোগ নিয়েও রোগি ভর্তি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেকে সিট না পেয়ে বারান্দা আর সিঁড়ির দোড় গোড়ায়ও শুয়ে পড়ছে মশারী টানিয়ে। এত কষ্ট সহ্য করা অভিভাবক মহলের তবু কোন আক্ষেপ নেই। আপনজনকে ঝুঁকিমুক্ত করতেই সব কষ্টক্লেশ। ওষুধ ও টেষ্ট নিয়েও অনেকের অভিযোগ। রোগি মারা যাবে যাক, সরকারি হাসপাতালের ‘সিরিয়াল কালচার’ আর হাসপাতাল কর্মীদের রূঢ় ব্যবহার যেন ডেঙ্গু রোগের চেয়েও আরও ভয়াবহ! আট ঘাটের জল খেয়ে, হাতে স্যালাইনের সুঁচ লাগাতে পারলেই যেন, সরকারি চিকিৎসা সেবাকে প্রণাম জানাচ্ছে ডেঙ্গু রোগি। আর এখনও টেষ্ট করতে না পারা পরিবার যেন তসবিহ নিয়ে বসে, উপরওয়ালার সদয় দৃষ্টি পানে চেয়ে শুধু প্লাটিলেট না কমার আর্জি পেশ করে চলেছেন। করোনার পর এ বছর ডেঙ্গুর কবলে আমরা যে কতটা অসহায়, তা বোঝা যায় দৈনিক কত জন আক্রান্ত হলো, কতজনের ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল এসব খবরগুলো যখন চোখের সামনে ভেসে আসছে। স্বাস্থ অধিদপ্তরের হিসেবেই একদিনে ২ হাজার ১৯৭ জন আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড আছে। আর রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ বছর বাংলাদেশের ডেঙ্গু রোগির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ১৯১ জনে। ঢাকায় বিপুল সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে চিকিৎসকগণ প্লাজমা লিকেজ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিজনিত সমস্যা ও প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কারণকে চিহ্নিত করেছেন। এ জন্য ঢাকা মৃত্যুহারও বেশি। প্রায় ০.৭ পার্সেন্ট। একবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগি পুনরায়ও আক্রান্ত হচ্ছেন, এমন রোগির সংখ্যাও ঢাকায় বেশি পাওয়া যাচ্ছে। শুধু আগস্ট মাসেই ৭১ হাজারের বেশি মানুষ এডিসের মরণকামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৩৪২ জন। বুঝতে তো কাঠের চশমার প্রয়োজন নেই ? কতটা ভয়াবহ শঙ্কায় আছি আমরা ?
কবি মহসিন সাহেব। দুই ছেলে আর স্ত্রী। বেচারার পরিবারে তিনজনেরই ডেঙ্গু। রাজধানীর খিদমাহ হাসপাতালে ভর্তি করান। রোজ ২ বার করে ব্লাড টেস্ট দিতে হয়। প্রতিবারই ১০০০ টাকা করে আসতে থাকে খরচের ভাউচার। ওষুধ সিট ভাড়া থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক প্রতি দিনে ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ। ২৬ জুলাই স্ত্রীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়। প্লাটিলেট সর্বনিম্নে নেমে আসে। রোগির একনাগারে বমি, ডায়রিয়া শুরু হলে খুবই আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসক আইসিইউতে নিতে বলেন। খিদমপাহ হাসপাতালে আইসিইউ সংকট দেখে স্ত্রীর জীবন বাঁচাতে রোগি নিয়ে যান কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক স্টেন্ট্রাল হাসপাতালে। ইমার্জেন্সী সেখানে আইসিইউতে রাখা হয়। ৩ দিন প্রতি দিন ২৫ হাজার টাকা করে ফি ধরা হয়। আর প্লাটিলেটের ফলাফল জানতে প্রতিদিন ১ বার করে করতে হয় ব্লাড টেষ্ট। খরচ সেই ১০০০ টাকা রোজ। এরপর আরও ৩ দিন। প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা খরচে চলে রোগির চিকিৎসা সেবা। ঢাকার আশে পাশে বনশ্রী ইউনিটি এইড হাসপাতাল, ফরায়েজী হাসপাতাল ছাড়া আরও প্রাইভেট ক্লিনিক হাসপাতালের ডেঙ্গু চিকিৎসার ধরন ও খরচ প্রায় একই ধরনের। এডিস মশা এত মানুষকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে বলার অপেক্ষা রাখে না। খিদমাহ হাসপাতালে তো ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট মাইকিং করে ডেকে ডেকে দিতে দেখা গেছে। স্ত্রীকে সারতে না সারতেই বেচারা কবি মহসিন সাহেবের ২ ছেলের আবার একে একে ডেঙ্গু। এবার আর তিনি ওদের কোন হাসপাতালে নেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। বড় ছেলে প্রচন্ড জ¦রে মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে যায়। তবু তিনি হাসপাতাল ক্লিনিকে দৌঁড় মারেননি। এবার তিনি সিরিয়াল নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছেন। প্রয়োজনীয় টেস্ট ও ওষুধ কিনে রোগি বাসায় নিয়ে আসেন। চালিয়ে যান স্যালাইন ও যাবতীয় চিকিৎসা। এর কারণ হিসেবে কবি স্ত্রীর বিষয় তুলে ধরেন। বলেন, ‘আমার স্ত্রী এ্যাজমা রোগি। আবার ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত ছিল। ডেঙ্গুরোগিকে সাপোজিটার দেয়ার নিয়ম আছে কিনা জানি না। প্রাইভেট হাসপাতালে আমার স্ত্রীকে জ¦র কমাতে অতিরিক্ত সাপোজিটার দিয়েছে। প্লাটিলেট ১০ এ নামায় আমি পাগলের মত ছুটোছুটি করে আইসিইউতে ভর্তি করি। ভাবুন, যদি সেদিন আইসিইউতে আমার স্ত্রীর জন্য একটু আশ্রয় না হতো আর একটু বিলম্বে হয় আমার সন্তান দুটো হয়ে যেতো মা হারা।’
এলাকা মহল্লার চিত্রটা আরও নাজুক। প্রতিটি ওষুধের দোকানে স্থানীয় চিকিৎসকের চেম্বারেও ডেঙ্গু রোগীর সিরিয়াল। এখন সিজনাল ভাইরাস জ¦র হলেও ডেঙ্গুর ভয়ে জলদি চিকিৎসকের সরনাপন্ন হচ্ছে অনেকে। রোগীর প্রকৃত ডেঙ্গু হয়েছে কিনা, সেটা নিরূপনেই ব্লাড টেস্ট একটি মুখ্য বিষয়। জ¦র নিয়ে চিকিৎসকের কাছে এখন যাওয়া মানেই- রোগির ইমুনোলজি যাচাই। ডাক্তার টেস্ট লিখে দেয় সাথে সাথে – ডেঙ্গু এন্টিবডি এলজিজি, ডেঙ্গু এন্টিবডি এলজিএম ও এনএস-১ অ্যান্টিজেন টেস্ট করে আসো। ব্যস, প্রতিটি এলাকার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল, ক্লিনিকে ‘এনএস-১ অ্যান্টিজেন’ টেস্ট এর খরচ মানেই চলছে দিশেহারা পরিবারের পকেট কাটার ধুম। কিসের সরকারি বিধিবিধান। কেউ তার পরিচিত জায়গা থেকে টেস্ট করবে। সেই সুযোগেও যেন তালা ! প্রাইভেট চেম্বারের চিকিৎসকরা অনেকেই তাদের নির্দিষ্ট স্থান থেকে টেস্ট না করলে, রোগী ছুঁয়েও দেখেন না বলেও অভিযোগ শোনা যায়। হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগি ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে ব্যর্থ হওয়া অনেক রোগিকে হাতে স্যালাইন লাগিয়ে বাড়ি ফিরতেও দেখা যাচ্ছে। এদিকে ডেঙ্গু রোগিকে প্রায় চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে বেশি করে পানি ও ডাব খাওয়ার পরামর্শের কথা বলায়ও ঘটছে বিপত্তি। পানির সহজলভ্যতা হলেও ডাবের মূল্য শতাব্দীর ইতিহাসকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। সুযোগে বাংলার সেরা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেড আর কিছু না পারুক, যেটার প্রয়োজন বেশি দাঁড়ায়, সেটার আকাশচুম্বী দাম বাড়িয়ে, মানবিকতার বুকে ছুঁড়ি চালিয়ে দেখিয়েছে, আমরা বাঙালী কি না পারি ? তা না হলে, এই দেশে ডাব ব্যবসায়ীদের নিয়েও বৈঠক করা লাগে ভোক্তা অধিকারের ! বিচিত্র এদেশ উন্নয়নের শীর্ষে না গেলে, একজোড়া ডাব ৫০০ টাকা হয় কি করে ? মানুষ মরছে ডেঙ্গুতে আর অমানুষ সব মেতে ওঠেছে যে যার ধান্দার বাণিজ্য খুলে…
ধান্দায় জ্ঞান বিনিয়োগ না করে মানুষ যদি কিছুটা সময় এডিশ নির্মূলে জনসচেতনা সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করত, তা হলে এই ডেঙ্গু হয়ত মহামারি আকার ধারণ করত না। এ বছরও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর দুই সিটিকে মশার বংশ শেষ করতে দেয়া হয়েছে ১৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ। ২০২৪ সালের ঠিক বর্ষার আগমনেই বোঝা যাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর ডিএনসিসি কে কতটুকু মানবতার ধর্ম পালন করতে পেরেছে ?
নাগরিক মনে কোন সচেতনার প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারাও এক ধরনের ব্যর্থতা। আমরা নাগরিক সমাজ এডিস নির্মূলে আজও উদারতার পরিচয় দিতে পারলাম না। না হলে বছর বছর এত চিৎকার চেঁচামেচি আর ডেঙ্গুরোগির মৃত্যুর পরও কেন আমরা এডিস মশাকে জিরো পার্সেন্টে আনতে পারছি না। সিটি কর্পোরেশন গুলো কিছু এলাকাকে চিহ্নিত করে রেড-এলার্ট জারি করেই খ্যান্ত। চলছে চিরুনি অভিযানও। কিন্তু সেই অনুপাতে প্রতি এলাকায় কি এডিশ নির্মুলে ভাল মানের কোন ওষুধ ছিটিয়েছে ? ঢাকার ভেতরের ডেঙ্গু রোগী ছঢ়াছড়ি যেসব এলাকায়, প্রায় প্রত্যেকটি এলাকার মানুষেরই ভেতরই সিটি কর্পোরেশনের এই অবহেলার বিষয়ে যথেষ্ঠ ক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়েছে। যার একটাই প্রধান কারণ- নিয়মিত তারা ওষুধ স্প্রে করে না। মশা তাড়াতে কান ফাটিয়ে ভো শব্দের কামান ঠিকই দাগায়। কিন্তু কার্যত ওসব ওষুধ মশার বংশ তো দূরের বাতিঘর, এডিস মশার রাজদরবারেই মনে হয় পৌঁছে না। কামান যদি রাজত্ব ধ্বংসই করত, তবে এত মরণঘাতী সৈন্য আসে কোথা থেকে, হ্যাঁ ?
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি
ছবিঃ সিফাত মাহমুদ ও ইমাম হোসেন (ফারুক)