ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি যে, যাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি তাদের কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর আশঙ্কাও তত কম। এ মুহূর্তে আপনি ঘরে থেকে কীভাবে আপনার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারেন, একটু ধারণা নেওয়া যাক।
প্রথমেই বলি, আপনাকে সুষম খাদ্য খেতে হবে, মানে মোট খাবারের ৫০-৬০ ভাগ কার্বোহাইড্রেট (ভাত, আলু, রুটি ইত্যাদি), ২০-২৫ ভাগ আমিষ (প্রধানত মাছ, মাংস, ডাল, দুধ, ডিম ইত্যাদি, সঙ্গে পর্যাপ্ত শাকসবজি) ও ১৫-২০ ভাগ চর্বিজাতীয় খাদ্য (রান্নায় ব্যবহৃত তেলসহ যে কোনো খাবার তেল/চর্বি, ডিমের কুসুম, মাছের তেল, পনির, মাখন ইত্যাদি।
সন্ধ্যা ৭টা-৮টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করুন। এই সময় ম্যাক্রো-পুষ্টি (কার্বোহাইড্রেট, আমিষ, ও চর্বি) একটু কম খেয়ে অনুপুষ্টির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। কিটোডায়েট (যেখানে শর্করার পরিমাণ কম ও ফ্যাটের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি) পরিহার করুন, তা না হলে আপনার মস্তিষ্ক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার দিকে মনোযোগ না দিয়ে কার্বোহাইড্রেট খুঁজে বেড়াবে তার নিউরন কোষগুলো সতেজ রাখার জন্য, যা এ মুহূর্তে ঠিক নয়। এখন অনুপুষ্টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। মূলত বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ খাদ্যই হচ্ছে অনুপুষ্টি। এগুলোর প্রধান উৎস হচ্ছে তাজা শাকসবজি ও ফলমূল। দামি বিদেশি ফল খেতে হবে এমন নয়, আমাদের দেশীয় ফল যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা, জাম্বুরা, আমড়া, আমলকী, জলপাই ইত্যাদি খুব বেশি বেশি খাওয়া যেতে পারে। লেবুর ওপর চাপ কমিয়ে অন্যান্য টকজাতীয় ফল খান
বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকার কারণে আপনার শরীরে সূর্যের তাপ লাগছে না, সেজন্য ভিটামিন ডি উত্পন্ন ব্যাহত হচ্ছে। তাই ভিটামিন ডি-যুক্ত খাদ্য, যেমন—সামুদ্রিক মাছ বা মাছের তেল, ডিমের কুসুম, কলিজা, দই ইত্যাদি খেতে হবে। পাশাপাশি চেষ্টা করুন বাসার ছাদে বা বাড়ির উঠানে গিয়ে শরীরে ২০-৩০ মিনিট রোদ লাগাতে। এছাড়া আপনার দৈনিক খাদ্যতালিকায় যেন অবশ্যই ভিটামিন বি-৩, জিংক, আয়রন, ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস-সমৃদ্ধ খাদ্য থাকে।
এখন আসুন, জেনে নিই এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে এবং শরীরে এগুলো কী কাজ করে। ভিটামিন বি-৩ (অন্য নাম নিয়াসিন বা নিকোটিনামাইড), যা মাছ, মাংস, বাদামি চাল, মাশরুম ও শাকসবজিসহ বিভিন্ন বীজ-জাতীয় খাবার, যেমন শিমের বীজ, মটরশুঁটি, বাদাম, অ্যাভোকেডো ইত্যাদিতে থাকে। কিছু কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে ভিটামিন বি-৩ ফুসফুসের সুরক্ষায় খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এবার আসুন জিংক সম্পর্কে জানি। এ মুহূর্তে এটা অত্যন্ত কার্যকরী একটি খনিজ, যা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সামুদ্রিক প্রাণী, বিশেষ করে শামুকে। এছাড়া মাংস, সয়াফুড, কালো তিসি, শিমের বীজ, মিষ্টিকুমড়ার বীজ, আলমন্ড, মসুর ডাল ইত্যাদিতেও পাওয়া যায়।
কোভিড-১৯ আরএনএ-পলিমারেজ এনজাইম (আরডিআরপি) দ্বারা ভেরো ই-৬ কোষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোষ বিভাজন শুরু করে। এ সময় জিংক মাঝখানে এসে বাঁধা দেয়, দ্রুত প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করে। যার ফলে ভাইরাসের কার্যকারিতা বাধাপ্রাপ্ত হয়। বয়স্কদের জিংকের অভাব একটি কমন বিষয়, তাই হয়তো তাদের মৃত্যুর হারও বেশি। জিংক দিনে ২০-২৫ মিলিগ্রাম হিসেবে খেতে পারেন, তবে দিনে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি খেলে শরীরের জন্য ক্ষতি হতে পারে। এবার জানব আয়রন সম্পর্কে, মাছ, মাংস, কলিজা, সবুজ শাকসবজি বিশেষ করে কচুশাক, পুঁইশাক, ব্রকলি ও বীজজাতীয় খাবারে পাওয়া যায়। কোভিড-১৯ একটি শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। আয়রন আপনার শরীরে অক্সিজেন-প্রবাহকে গতিশীল করবে। এবার জানা যাক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস সম্পর্কে, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ক্যারোটিন, ইত্যাদি হচ্ছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস।
আমাদের শরীরে বিভিন্ন মানসিক চাপের প্রভাবে, প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া ও বিভিন্ন ভেজাল খাদ্যের মাধ্যমে মুক্ত আয়ন (বলতে পারেন ব্রেকআপ হওয়া প্রেমিক প্রেমিকা) উত্পন্ন হয়, যা পুনরায় অন্য কোনো ইলেকট্রনের সঙ্গে জোড়া বাঁধতে চায় এবং আমাদের শরীরের জোড়া আয়নগুলোকে ভেঙে দিয়ে সুস্থ কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ সময় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস এসে মুক্ত আয়নগুলোকে আটকে ফেলে এবং সুস্থ কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। মধু, দই, আদা, রসুন, কাঁচা হলুদ, কালজিরা, তিসি, আদা চা, লেবু চা ইত্যাদি বেশি বেশি খান।
এখানে উল্লিখিত প্রায় সবই আমাদের হাতের নাগালে, শুধু একটু সচেতনতা প্রয়োজন। কাঁচাসবজি ও অর্ধসিদ্ধ খাবার, পচা-বাসি খাবার, ভাজাপোড়া বিশেষ করে পুরাতন তেলে উচ্চ তাপমাত্রায় ভাজা খাবার, প্রাণিজ চর্বি, জন্মদিনের কেক বা রুটির ওপরে ব্যবহূত ক্রিমসহ সমস্ত ট্রান্সফ্যাট, ধূমপান ও অ্যালকোহল জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ঘরে থাকুন, হালকা ব্যায়াম করুন, মাল্টি-ভিটামিন মিনারেলস ট্যাবলেট খেতে পারেন, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি বা অন্যান্য খাবার অবশ্যই গরম করে খান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক পড়ুন, জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। সুস্থ থাকুন সুস্থ রাখুন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ