২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ৩:৫৭
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ৩:৫৭

কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই অনেক জেলায়

গত বছর দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে আক্রান্ত রোগীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য সব জেলায় কম-বেশি প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ঝালকাঠিতেও সুস্থ ব্যক্তিদের থেকে কভিড-১৯ রোগীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ব্যবস্থা প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জেলাটিতে আট শয্যার প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেখানে এখন আর এ ব্যবস্থা নেই।

শুধু ঝালকাঠি নয়, দেশের এমন ১৪টি জেলা করোনা রোগীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ব্যবস্থায় পিছিয়ে রয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, এসব জেলার প্রতিটিতে ৫০ শয্যার কম প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বাস্তবে কোথাও কোথাও সেগুলো প্রায় অকার্যকর, আবার কোথাও বিলুপ্তই হয়ে গেছে। বিষয়টি অনেকটা কাজির গরুর মতো। কেতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, সংক্রমণের হার এতই বেড়েছে যে রোগীদেরই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না। সেখানে এখন আইসোলেশনের বিষয়টি নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ তাদের নেই।

অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে যেন সংক্রমণ না ছড়ায় সেজন্য আক্রান্তকে আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। এতে ভাইরাস ছড়ানোর শঙ্কা যেমন কমে, তেমনি হাসপাতালের ওপর চাপও কমে। তাই আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা সম্ভব না। জেলা পর্যায়ে অনেক পরিবারে আক্রান্ত সদস্যকে আলাদা করে রাখার সুযোগ থাকে না। তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তি যাদের অবস্থা জটিল নয় তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে বা বাড়িতে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকা উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করে সরকার। গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি করোনা রোগী বা উচ্চ সন্দেহজনককে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। দেশের আট বিভাগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ৭ হাজার ১৭২টি আইসোলেশন শয্যা রয়েছে। তবে এ শয্যাগুলো ঠিক কোথায় তা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ আইসোলেশনে রয়েছে বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে এদের অবস্থানও জানাতে পারেনি অধিদপ্তরটি।

কাগজে-কলমে আইসোলেশন শয্যায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। বিভাগটিতে ১ হাজার ৩৬৬টি আইসোলেশন শয্যা রয়েছে। ৫৪৩টি শয্যা নিয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ। পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর মধ্যে ঝালকাঠিতে আটটি, নড়াইল ও মাদারীপুরে ১৮টি করে ৩২টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২০টি, গোপালগঞ্জে ২১টি, লালমনিরহাটে ২৬টি, পঞ্চগড়ে ২৭টি, মেহেরপুর ও গাজীপুরে ৩৫টি করে ৭০টি, রংপুরে ৩৬টি, নরসিংদীতে ৩৯টি, রাজবাড়ীতে ৪০টি, খাগড়াছড়িতে ৪৮টি এবং নাটোরে ৪৯টি আইসোলেশন শয্যা থাকার কথা। কিন্তু এসব জেলার কোনো কোনোটিতে ১০টি শয্যাও নেই। গত বছর করোনা মহামারী শুরুর পর আইসোলেশন সেন্টার বা ওয়ার্ড চালু করা হলেও এখন বেশির ভাগ জেলায় তা বিলুপ্তের পথে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের সব উপজেলা এবং জেলায় আইসোলেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এজন্য শুরুতে সরকার প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল। দুই মাস আগে আবারো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

তবে এখন মাঠ পর্যায়ে আইসোলেশন শয্যা বা এর ব্যবহারের দেখা মেলা ভার। ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ডা. রতন কুমার ঢালী বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছর শুরুতে আমাদের এখানে আইসোলেশন ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ডায়রিয়া ওয়ার্ডকে আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হয়েছিল। এখন রোগীর এত চাপ যে আইসোলেশন করা হয় না। করোনা ওয়ার্ডেই রোগীকে জায়গা দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

ঢাকা বিভাগের ১৩ লাখ লোকসংখ্যার জেলা মাদারীপুর। শুরুতে জেলায় প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা থাকলেও এখন নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ১৮টি শয্যার কথা বলা হলেও তা জানেন না মাদারীপুর সিভিল সার্জন ডা. মো. সফিকুল ইসলাম। তার পরামর্শ অনুযায়ী কার্যালয়ের পরিসংখ্যানবিদ রিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও আইসোলেশনের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

সংক্রামক ব্যাধি করোনার প্রাদুর্ভাব কমাতে হলে রোগী আইসোলেশন করা অন্যতম শর্ত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আইসোলেশন হলো রোগীকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা রোগী বা চূড়ান্ত সম্ভাবনা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের আইসোলেশন করে রাখতে হয়। এতে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ঠেকানো যায়। বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক হতে পারে। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আইসোলেশন মানুষ মানতে চায় না। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন জরুরি। যেখানে কেউ আসবে না ও যেখান থেকে কেউ বাইরে যাবে না। খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিছুটা চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণও থাকতে হবে।

মফস্বলের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলে তারা আইসোলেশন বোঝে না উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, গ্রামের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলে তারা পরিপূর্ণ আইসোলেশনে থাকতে পারে না। একদিকে তারা তা বোঝে না, অন্যদিকে তাদের সবার আলাদা ঘর নেই। তাই উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যেসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বা অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি স্থাপনাকে আইসোলেশন সেন্টার করে তাদের সেখানে রাখা উচিত। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিষয়টি খুবই কার্যকর বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজধানী ও বিভাগীয় শহর বাদে মফস্বলে সাধারণত বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার সুযোগ কম বলে মনে করছেন সরকার গঠিত করোনা প্রতিরোধে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বড় একটি অংশের মধ্যে উপসর্গ দেখা যায় না। আবার কিছু ক্ষেত্রে মৃদু লক্ষণ দেখা যায়। এমন রোগীরা সাধারণত বাড়িতে আইসোলেশনে থাকলেও সতর্ক হয় না। তারা অন্যদের সংক্রমিত করে। মফস্বলে এমনটি বেশি দেখা যায়। সেক্ষেত্রে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা জরুরি। এর জন্য হাসপাতাল প্রয়োজন নেই। যেকোনো ভবনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আইসোলেশন সেন্টার বা ওয়ার্ড বানানো যায়। খরচ খুবই কম। আলাদা কোনো অবকাঠামোরও প্রয়োজন হয় না। সংক্রামক রোগকে যত সীমাবদ্ধ স্থানে রাখা যাবে তার বিস্তার ততই কমবে।

Facebook
Twitter
LinkedIn