কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী। বর্বরোচিত কলঙ্কয়ময় একটি ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা ইতিমধ্যেই ব্যপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
ঘটনা কি ?
রাধাপদ রায়। যিনি একজন চারণ কবি। গান বান্ধে। নিজের দরাজ কণ্ঠে স্বরোচিত সেই গানগল্প মানুষকে শুনিয়ে যাঁর আনন্দ। মনের ক্ষুধাও মেটান পল্লীর এই চারণ কবি। নিজের গীত নিজে রচনা করায় ভাবের জগতে তাঁকে প্রবেশ করতে হয়। বিভিন্ন ভারী কথাকে কখনও সুরের জাদুতে মিশিয়ে, লোকমুখে মেলে ধরতে হয়। মানুষটি পুরোদস্তুর গানের পাখি, সুরের পাগল। আর তার এই গান ও সুরই যেন সমাজের বেশ কিছু লেবাসধারী বক ধার্মীকের কাছে কাল হয়ে দাঁড়ায় ? এলাকার উঠতি সংস্কৃতি বিরোধী ‘কদু ও রফিকের কানে জ্বালা ধরায় – চারন কবি রাধাপদ রায়’র কথা ও গান : –
‘‘সরকারি চাকরি করে বেতন পাঁচ হাজার,
পঞ্চাশ হাজার টাকা মাসে খরচ দেখি তার ।
বাকী টাকা কেমনে আসে সেকথা আর বলিনা-
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা।’’
যেই গানে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন মহত্ম নাই। বরং কেয়ামতের নমুনা সবাই জেনেও সেই মোতাবেক কাজ না করা, না মানা মানুষদেরই সজাগ করেছে যেই চারণ কাব্য ! ধর্মীয়-অনুশাসন ভালো। তবে কট্টরতা মুক্ত হওয়া উচিত। এখনও সমাজে লাল-সালুর সেই মজিদদের দেদাড় বিচরণ আমরা লক্ষ্য করছি। গ্রামাঞ্চল যে এখনও পুরোপুরি কুসংস্কার ও অতিমাত্রিক অনুশাসন থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ৩০ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। চারণকবি রাধাপদ রায়’র সাথে মাসখানেক আগে থেকেই কদু ও রফিক গংদের বিরোধ চলছিল। খবরে প্রকাশ: ‘‘ছেলের কাছে পাওনা অল্প কিছু ঋণের টাকাকে কেন্দ্র করেই বিরোধের সূত্রপাত।’’ এমনকি ঘটনার দিন দুইপক্ষের বেশ উত্তপ্ত তর্কবিতর্ক ঘটে। এরপরই গ্রামের ক্ষেপাটে বখাটে শ্রেণীর মাতব্বর সাজা কদু ও রফিকসহ তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা একজন বৃদ্ধ মানুষের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। আঘাতে আঘাতে মানুষটার পিঠ ক্ষত-বিক্ষতও করে দেয়। একে তো চারণ কবি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। আবার যার কাব্যধারায় উঠে এসেছে ধর্মের গুরগম্ভীর কথা। সেকারণে, এই অমানবিক অত্যাচারকে খালি চোখে শুধু ‘ঋণের অল্প টাকা’র জন্য ঘটেছে, সেটা জোড় দিয়ে বলা যাচ্ছে না। ধর্মকে পুঁজি করে অন্যধর্মের মানুষকে হেয় করা হচ্ছে কিনা, সেটাও আইন প্রশাসনের খতিয়ে দেখা উচিত।
চারণ কবির কাব্যই যার জীবন। যার জীবিকা। সেই মানুষটিকেই নিষ্ঠুরেরা ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। জ্বালাপোড়া- দগদগে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। যার মানবিক লাল রক্তে রঞ্জিত হয়েছে হাসপাতালের বিছানা ।
মানবধিকার সংস্থা, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী সমাজের বজ্রকন্ঠ ও প্রতিবাদ, নিন্দা জ্ঞাপনে প্রশাসন এগিয়ে এসেছে। সুখবর। মূলহোতা রফিকুল ইসলামকে আটকও করা হয়েছে। কদুর আলীসহ পুরো গংকেও দাঁড় করানো হোক কাঠগড়ায়। ষড়যন্ত্রমূলক এই হামলা ও অত্যাচারের প্রকৃত রহস্য এখন বেড়িয়ে আসা সময়ের ব্যাপার।
কবিতা লিখে, গান তুলে, কি অন্যায় আর কিইবা পাপ করেছেন, প্রায় আশি বছরের এই বৃদ্ধ চারণ- কবি। এলাকার মানুষকে নিজের লেখা গান, কবিতা, গল্প ফেরি করে বেড়ানো স্বাধীন মানুষটি আজ পুরোই নির্বাক !
গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে সমাজের নানান সমস্যা ও অসঙ্গতি নিজের কবিতা, গল্পে, গানের ভাষায় মানুষকে শুনিয়ে এসেছেন। বয়স্ক মানুষের ‘অল্প স্বল্প গল্প’ শুনে যে যা দিয়েছেন, সেই অর্থেই চলছিলো জীবন ও জীবিকা। কদু ও রফিক গুন্ডাবাহিনী মানুষটির মনন, মেধা ও কণ্ঠকেই শুধু অবরুদ্ধ করেনি। মানুষটির রুটি রুজির ওপর চালিয়েছে ‘পাষবিক ও অমানবিক’ বুলডজার !
ঘটনাবিবরণীতে যা জানা যায়: কদু-রফিক গং মানুষটির বিরুদ্ধে পুরো চক্রান্ত করেই একটি গ্রাম্য শালিশ ডাকে। এখানে সবার সামনে চারণ কবির কবিগানের বিরুদ্ধেও ওরা আঙুল তুলেছে। একপর্যায়ে কথা কাটাকাটির জের থেকেই গত শনিবার এই গুণীজনের ওপর অতর্কিত ও পাশবিক অমানবিক হামলা চালায় পাষুন্ডরা।
এই হামলার উদ্দেশ্য কী ? বৃদ্ধ কবিকে ক্ষতবিক্ষত করার মাধ্যমে তারা এলাকায় কিসের দাপট ও প্রভাবকে তুলে ধরতে চায় ? রফিকুল ইসলাম ও কদুর আলীরা কি চায় ? এমন প্রশ্নই এখন পরিস্কার।
চারণ কবি রাধাপদ রায়ের ছেলে ও পরিবার যেমন সংস্কৃতি বিরোধী এক শ্রেণীর কট্টর বাহিনীর শঙ্কা থেকে নিরাপদ নয়। দেশে, এখনও অনেক রাধাপদ রায় আছেন যারা, নব গর্জে ওঠা কট্টর মৌলবাদী শ্রেণীর হাতে জিন্মি ? এই ঘটনা থেকেই সেটা আজ প্রমাণিত। সময় এসেছে এখন এদের রুখে দেবার ? না হলে এরা ধীরে ধীরে ‘ধর্মের দোহাই’ দিয়ে আরও ভয়ঙ্কর রকমের বাড়াবাড়ি করার সাহস অর্জন করে ফেলবে।
মানবিকতার রাষ্ট্রে কট্টরপন্থী, মৌলবাদীদের ঠাঁই নেই এদেশে।
বর্বরোচিত হামলায়- কুড়িগ্রামবাসীর সাথে সারা দেশের মানুষ কতটা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ মুখর। হাসপাতালে শুয়ে চারণ কবির নির্ভাক চোখ নিশ্চয়ই, অবলোকন করেছে … বলা যায়, সমাজের কাপুরুষদের হাজারো চাবুকের আঘাতের চেয়েও মানুষের ভালোবাসার শক্তিই জয়যুক্ত করেছে এই চারণ কবিবে।
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি