২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ১২:৪৫
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ১২:৪৫

চট্টগ্রামে ভোটে রক্তপাত

সহিংসতা, অনিয়ম আর রক্তপাত। গেটে জটলা। ভেতরে ভোটার নেই। ইভিএমের গোপন কক্ষে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি। এসবের মধ্য দিয়েই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভোট হয়ে গেল। সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অন্তত দুইজন। সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এর আগেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়।

ভোট নিয়ে কথাকাটাকাটির জেরে নগরীর সরাইপাড়া এলাকায় মো. সালাউদ্দিন কামরুলের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন তার ভাই নিজামউদ্দিন। নগরীর বেশির ভাগ কেন্দ্রেই বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না। ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। কোথাও কোথাও ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়েও ভোট দিতে পারেননি। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট হয়েছে। নিজের জয়ের ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। অন্যদিকে, বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত অভিযোগ করেন তার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।

গতকাল ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ঘটে একের পর এক বিস্ফোরণ। নগরীর চান্দগাঁও, চকবাজার, লালখান বাজার, পাঠানটুলি, উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা, পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজার, আগ্রাবাদ, সরাইপাড়া ও পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ঘটে এই বিস্ফোরণ। শুরুতে আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় ভোটাররা আর কেন্দ্রমুখী হননি।
সকাল ১০টার দিকে নগরীর বাকলিয়া বিএড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেন বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, কেন্দ্র দখল করে নগরীর খুলশী, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, লালখান বাজার ও পাহাড়তলীসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে আমাদের এজেন্টদের মারধর করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। আমাদের নারী কর্মীদের গায়েও হাত তোলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকেই ভোটকেন্দ্র দখলের পাঁয়তারা চলে। আমি তিনজনের কাছে অভিযোগ পেয়েছি, গোপন কক্ষে অন্য একজন দাঁড়িয়ে থেকে ভোটারদের আঙুলের ছাপ দেয়ার পর নিজের ইচ্ছামতো ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। ইভিএমে এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে ভোট ডাকাতির মহোৎসব চলে দিনভর। অথচ প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে নয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গেই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ডা. শাহাদাত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করে আসছি। মাঝপথে ভোট থেকে সরে যাবো না। বরং আওয়ামী লীগের বেহায়াপনা ও ভোট ডাকাতির চিত্র বিশ্বকে দেখিয়ে দেবো। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরেননি তিনি। তবে নিজের ভোট দিতে না পেরে ক্ষোভে নির্বাচন বর্জন করেছেন বিএনপি সমর্থিত লালখান বাজার ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী মনোয়ারা বেগম। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বুধবার সকাল ৯টায় নিজের ভোটই দিতে এসে দিতে পারেননি। তার এজেন্টদের মেরে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা হয়েছে। এ নির্বাচন স্থগিত করার দাবি করেন তিনি।  

এদিকে কেন্দ্র দখল করে ইভিএমে ভোট জালিয়াতির প্রতিবাদ করায় নগরীর ৩৪ নং পাথরঘাটা ওয়ার্ডে একটি ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র কাউন্সিলর প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় ইভিএম ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বিএনপি সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল হোসেন বালিকে আটক করে। বেলা ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনায় ওই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।
নাসরিন আক্তার নামে বালির একজন এজেন্ট বলেন, কেন্দ্রের গোপন কক্ষে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকরা দাঁড়িয়ে জালিয়াতি করে জোরপূর্বক পছন্দের প্রতীকে ভোট নিচ্ছিল। এর প্রতিবাদ করায় পুলিশ আমাদেরকে মারধর করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর অনুসারীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। এতে সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে কে বা কারা ভোটকেন্দ্রে ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করে। এরপর আমাদের প্রার্থী ইসমাইল হোসেন বালিকে আটক করে। তাকে আটকের কারণ জানতে চাইলেও জানায়নি পুলিশ।

কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, সংঘর্ষ ও ইভিএম মেশিন ভাঙচুরের ঘটনায় ইসমাইল হোসেন বালিকে আটক করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।   
এভাবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের বিভিন্ন  ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ইউসেফ আমবাগান কারিগরি স্কুল ভোটকেন্দ্র দখলের ঘটনায় সংঘর্ষে নিহত হন আলাউদ্দিন।
অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা প্রথমে হামলা চালায়। এতে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী মাহামুদুর রহমানের অনুসারীরা আহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

এ ঘটনায় আহত ৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে আলাউদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। নিহত আলাউদ্দিন বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহামুদুর রহমানের অনুসারী। এ ঘটনার জন্য ওয়াসিমের অনুসারীদের দায়ী করেছেন মাহমুদুর রহমান।
এদিকে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য নগরীর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে ছুরিকাঘাতে একভাইকে খুন করেছে আরেক ভাই। নিহত ভাইয়ের নাম মো. নিজামউদ্দিন। আর ঘাতক ভাইয়ের নাম মো. সালাউদ্দিন কামরুল। বুধবার সকাল ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে বলে জানান পাহাড়তলী থানার ওসি (তদন্ত) রাশেদুল হক।

তিনি জানান, ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে খুন হওয়া নিজামউদ্দিন নগরীর ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী সাবের আহম্মদের কর্মী। ঘাতক সালাউদ্দিন কামরুল একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আমিনের কর্মী।

রাশেদুুল হক বলেন, বুধবার সকালে ভোট দিতে যাওয়ার সময় ঘাতক সালাউদ্দিন কামরুল তার ভাই নিজামউদ্দিনকে নুরুল আমিনের প্রতীকে ভোট দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু নিজামউদ্দিন তাতে রাজি না হওয়ায় দু’জনের মধ্যে ঝগড়া বাধে। একপর্যায়ে সালাউদ্দিন কামরুল নিজামউদ্দিনকে ছুরিকাঘাত করে। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু ঘটে।

এ ছাড়া কেন্দ্র দখলের ঘটনায় নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল হাসনাত মো. বেলালের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে প্রতিপক্ষ দিদারুল আলম মাসুমের অনুসারীদের। দিদারুল আলম মাসুম আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মানিকের পক্ষে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে ২০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

কেন্দ্র দখলকে কেন্দ্র করে নগরীর বাকলিয়া, চান্দগাঁও, উত্তর পাহাড়তলী, পশ্চিম ষোলশহর, চকবাজার, রামপুর, উত্তর পতেঙ্গা, ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলে দিনভর।

তবে সিএমপি’র উপ-কমিশনার মো. আবদুল ওয়ারিশ বলেন, সহিংসতা যখন যেখানে দেখেছি, পুলিশ তখনই সেখানে ব্যবস্থা নিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভোটকেন্দ্রগুলোতে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। ফলে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।  

আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী সকাল নয়টায় বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করে বহদ্দারহাট এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে নিজের ভোট প্রদান করেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ হচ্ছে। নৌকার জয় সুনিশ্চিত।  

Facebook
Twitter
LinkedIn