চৈত্রের খরতাপে কপাল পুড়ছে কৃষকের। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের বোরো ধান চাষিদের মধ্যে এখন আহাজারি, আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত ৪ এপ্রিল রাতে আচমকা গরম বাতাসে হাওরাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কমবেশি পুড়ে গেছে প্রায় ৪৮ হাজার হেক্টর জমির ধান। ৫০ শতাংশের কম পুড়ে যাওয়া ধানক্ষেতে পানি ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)।
ব্রির মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবীর গতকাল বিকেলে নয়া দিগন্তকে জানান, এ পর্যন্ত ৪৮ হাজার হেক্টর জমি এফেক্টেড হয়েছে। এটা বিভিন্ন লেভেলে। কোনো কোনো জমি ৮০ শতাংশ পর্যন্ত, কোনো জমি ৩০-৪০ শতাংশ বা এর কম বেশি। ৫-১০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে এমন জমিও রয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এসব ধানের জমিতে এখন পানি ধরে রাখা খুবই জরুরি। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় খুব সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে। কারণ এই এলাকায় খাল-বিল বা ডোবা থেকেই পানি সেচ দেয়া হয়। কোনো নলকূপ নেই।
শীতকাল তথা নভেম্বর বা বাংলা সনের কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে বোরো মৌসুম শুরু হয়। আর শেষটা হয় চরম গরম তথা এপ্রিল-মে (বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ) মাসে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়। ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর বলেন, বোরো ধানের যে সব জাত ফুল ফোটার পর্যায়ে আছে বা এখন ফুল ফুটছে বা সামনে ফুল ফুটবে, সে সব জমিতে পানি ধরে রেখে ধানের ফুল ফোটা পর্যায়ে হিট শক/ হিট ইনজুরি থেকে রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে, বাকিটা বাঁচানোর জন্য এ উদ্যোগ নিতে হবে। পানি ধরে রাখতে হবে- এটাই আমাদের সাজেশন।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে জমিতে অন্তত ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখার জন্য বলা হয়েছে। যাতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও পানি থাকলে তা কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যদি তাপমাত্রা রাখা যায়, তাহলে এ সমস্যা হবে না। যেখানে ঝড় হয়েছে, সেখানে পাতাপোড়া রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, সেখানে ৬০ গ্রাম এমওপি সার, ৬০ গ্রাম থিওভিট ও ২০ গ্রাম জিংক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকেলে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো: মেসবাহুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীরসহ সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ব্রির মহাপরিচালক নয়া দিগন্তকে বলেন, আপনারা তো জানান, ১৫ মার্চের পর থেকে তাপমাত্রা অনেক বেশি। বৃষ্টিও হচ্ছে না। ৩৫ ডিগ্রির ওপরে যদি তাপমাত্রা থাকে এবং সেই সময় যদি ধানের ফুল আসে, তখন পোলেনটা (রেণু) শুকিয়ে যায়। তখন পরাগায়ণ হয় না। ওই সময়ে (৪ এপ্রিল আগে পরে) ৩৬-৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা ছিল। ৪ তারিখের ঝড়ো, গরম বাতাস প্রবাহিত হওয়ার কারণে এটা হয়েছে। এই সময় যেসব ক্ষেতে ধানে ফুল ফোঁটা অবস্থায় ছিল সেগুলোই ক্ষতি হয়ে গেছে।
কতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা এখন নির্ণয় করা হচ্ছে জানিয়ে ড. মো: শাহজাহান কবীর বলেন, পরিসংখ্যানটা ঠিক থাকছে না। কারণ আজকে একটা করছি, কালকে আবার বেড়ে যাচ্ছে। কারণ বৃষ্টি তো হচ্ছে না। এই মুহূর্তে আমাদের সাজেশন ছিল জমিতে পানি ধরে রাখা। কিন্তু হাওর এলাকায় ওরা (কৃষক) পানিও দিতে পারছে না। এটা হলো আরেকটা সমস্যা। তিনি বলেন, হাওরের অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে নলকূপ নাই। তারা বিল বা ডোবার পানির ওপর নির্ভরশীল। একটা পর্যায় পর্যন্ত এই পানি দিতে পারে। এরপর বৃষ্টির ওপর নির্ভর করেন। বৃষ্টি হলে ফসল ভালো হয়, না হলে ভালো হয় না।
ঝড়ো বাতাসে ধানের ক্ষতি বিভিন্ন লেভেলে হয়েছে উল্লেখ করে ব্রির এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ৫-১০ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে। ৮০ শতাংশ বা এর কম বেশি যেসব ক্ষেতের ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো ধরে নিতে হবে যে পুরোপুরিই ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরে ৩০-৫০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো এখনো হয়তো জমিতে পানি দিয়ে রাখা হলে ক্ষতির পরিমাণ কমবে। এটাই চেষ্টা করছি সবাই মিলে যে, পানিটা যেন দেয়া যায়। গতকাল বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে। আজকের (শুক্রবার) তাপমাত্রা একটু কম আছে, ৩৫ ডিগ্রি।
পানি দিলে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও ২-৩ ডিগ্রি কমে যাবে। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির নিচে রাখতে পারলেই হয়। তাহলে আর পোলেন পুড়ে বা শুকিয়ে যাবে না।
ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ব্রির মহাপরিচালক বলেন, ক্ষতি নিরূপণে কাজ চলছে। যেমন যেসব জমির ৩০-৪০ শতাংশ বোরো ধান ক্ষতি হয়েছে, সেসব ধান পাকার পর কৃষক যদি শ্রমিক দিয়ে কাটায় তাহলে তাদের পোষাবে না। তাই চিন্তা করা হচ্ছে, সরকারি খরচে যদি কেটে দেয়া যায়। এখন তো মেশিন আছে কম্বাইন হারভেস্টার। যারা গরিব মানুষ, তাদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায় সেটাও এক ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটা কী ধরনের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষতিটা পুষিয়ে দিতে সব ধরনের সহযোগিতা হতে পারে। এমন হতে পারে যেমন, যেসব এলাকায় আউশ বা আমন ধান চাষ হয়ে, সেসব এলাকার কৃষককে প্রণোদনা দেবে সরকার। আর হাওরে যারা (চাষি) আছেন তাদের তো আগামীতে কোনো ফসল নাই। তাই সেখানে হয়তো সরকার ক্ষতি অনুযায়ী ক্যাশ টাকা অ্যাকাউন্টে দিতে পারে। এটা দিয়েই একটা তালিকা করা হচ্ছে। যাতে সেটা অথেনটিক গ্রহণযোগ্য তালিকা হয়।
যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব কৃষকের তালিকা হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ সেখানে উল্লেখ থাকবে, সেই অনুযায়ী সরকার সহযোগিতা করবে। এর আগে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদকের সাথে বোরো ধানের ক্ষেত পুড়ে চিটা হওয়ার বিষয় নিয়ে কথা হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহর সাথে। তিনি বলেন, গরম বাতাসে এরকম ব্যাপকহারে ধান চিটা হওয়ার ঘটনা অতীতে হয়নি। হলেও অল্প জমিতে হয়েছে। এরকম ব্যাপকভাবে হয়নি। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকার তাদের পাশে দাঁড়াবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, যেসব ধানক্ষেতে ফুল আসছে, যেখান দিয়ে বাতাস বয়ে গেছে সে জায়গায় ধানের ফুলের রেণুটা পুড়ে গেছে। যার ফলে পরাগায়ণ আর হবে না। তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এবার ৪৮ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের টার্গেট ছিল। আবাদ হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ বেশি হয়েছে। সুতরাং এই ক্ষতি সামগ্রিকভাবে জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তায় কোনো প্রভাব পড়বে না। গতবারের চেয়ে এবার ফলন আরো ভালো হবে আশা করি। কিন্তু যেসব কৃষকের ক্ষতি হলো এটাই বিষয়। আর যদি কোনো দুর্যোগ না হয়, তাহলে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব ইনশাআল্লাহ। সরকার তাদের পাশে দাঁড়াবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে যাদের আউশ ধান আবাদের সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের আউশে প্রণোদনা দেবো। যাদের আউশ নাই, আমনে দেবো, আমন না থাকলে আগামী বছর বোরোতে দেবো। এ ছাড়া তাৎক্ষণিক কী করা যায় সেটাও আমরা ভেবে দেখছি। মোট কথা সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াবে।
কুলিয়ারচরের হাজারো কৃষক দিশেহারা
কুলিয়ারচর (কিশোরগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে ফসলের মাঠে দুলছে বোরো ধানের শীষ। কৃষকের চোখে হাজারও স্বপ্ন ছিল কিন্তু সেই স্বপ্নে আকস্মিক হানা দিয়েছে বোরো ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গরম দমকা হাওয়া ও ঝড়ো বাতাস। গত (৪ এপ্রিল) রোববার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত আচমকা গরম দমকা হাওয়া ও ঝড়ো বাতাসে ধানের শীষে আঘাত করায়, বোরো ধানের নতুন শীষ বিবর্ণ ও সাদা রঙের হয়ে যাচ্ছে। ঝড়ের পর থেকে যতই দিন যাচ্ছে ততই কৃষকরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছে।
শুক্রবার গতকাল সকালে উপজেলার ছয়সূতী ইউনিয়নের ভাগমারা ও পাচাটিয়া বন্ধে এবং সালুয়া ইউনিয়নের দড়িগাঁও, মাইজপাড়া ও গণকখালী এলাকার ধানী জমিতে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ধানগাছের পাতা সবুজ থাকলেও কিছু ধানের শিষ ধূসর ও সাদা হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পাকা ধান কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায় ধান ধূসর হয়ে আছে। ধানের ভেতরে চাল নেই। উপজেলার সালুয়া ইউনিয়নের দড়িগাঁও বন্ধে গিয়ে কথা হয়, মোহাম্মদ আতর মিয়া (৬০) ও মো: দুলাল মিয়ার (৫০) সাথে তারা জানান, প্রায় ২২০ শতাংশ জমিতে তারা বোরো ধান (জিআর ২৯ জাতের ধান) চাষ করেন, কিন্তু আচমকা গরম হাওয়ায় তাদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই গেছে।
ভাগমারা বন্ধে গিয়ে কথা হয় কৃষক ছায়েদুল্লাহর সাথে। ধানক্ষেতের কী অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ৭০ শতাংশ জমিতে বোরো ধান রোপণ করেছি এর মধ্যে ৫০ শতাংশ বিআর ২৯ জাতের ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। তার ভাষায় এই আগুন্যা বাতাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিআর ২৯ জাতের ধান। গরম ঝড়ো হাওয়ায় পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে কৃষকদের স্বপ্নের বোরো ধান। ধানের শীষে ফুল আসা অবস্থায় কৃষকদের বোরো ধান হঠাৎ করে প্রচণ্ড গরম ও ঝড়ো হাওয়ায় সম্পূর্ণভাবে চিটা হয়ে গেছে। জমিতেই শুকিয়ে যাচ্ছে ওইসব ধানের গাছ ও পাতা। অনেক কৃষক বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও থেকে ঋণ এনে চাষাবাদ করেন এবং অনেক কৃষক সুদে টাকা এনে বোরো আবাদ করেন। গরম হাওয়ায় এখন হাজারো কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছে।