অক্টোবর মাস শেষ হচ্ছে আজ। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হবে দুই মাস পর। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের একটি বইও ছাপা হয়নি। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে প্রায় অর্ধেক বই ছাপা শেষে উপজেলায় পৌঁছে যায়। এবারে সরকার সোয়া ৩৩ কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের বই-ই প্রায় ১০ কোটি।
অন্যদিকে মাধ্যমিকের বই ছাপা কাজ চললেও এর অগ্রগতি তেমন ভালো নয়। রোববার পর্যন্ত মাত্র দুই কোটি বই মুদ্রিত হয়েছে। এছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে বই দেওয়ার কথা। ওই দুই শ্রেণির বইও এখন পর্যন্ত প্রস্তুতই হয়নি। এ অবস্থায় নতুন বছরের প্রথম দিন শিশুদের হাতে পুরো সেট বই না পৌঁছানোর শঙ্কা প্রবল।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ছাপার কাগজ এবং বিদ্যুতের লোডশেডিং অন্যতম সংকট। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি কারণ আছে। এক মুদ্রাকর জানান, তারা যখন বইয়ের দরপত্রে অংশ নেন তখন কাগজের দর ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৮০-৮৫ হাজার টাকা। তা বর্তমানে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ডলার সংকট এং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের পাল্প আমদানিও বিঘ্নিত হয়। ফলে সার্বিক কাগজ উৎপাদনই কমে গেছে। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান বইয়ের কাজ পেয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই রাজধানীর বাইরে অবস্থিত। রাজধানীতে পালাক্রমে ঘণ্টা ধরে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং থাকলেও ঢাকার বাইরে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ছাপাখানার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে একাধিক মুদ্রাকর যুগান্তরকে জানান। এসব পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিপিই’র সৃষ্ট সংকট। মুদ্রাকরদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী নিুমানের বই দিলে কিংবা বইয়ের বাঁধাই খুলে যাওয়াসহ অন্য সমস্যা হলে ৬ মাসের মধ্যে নতুন বই সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি জরিমানাও হবে। কিন্তু ৯-১০ মাস পরও সংস্থাটি আনন্দ প্রিন্টার্সসহ ৫টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, একটি বাদে গত বছর পাঠ্যপুস্তকের কাজ করা কোনো প্রতিষ্ঠানেরই জামানতের টাকা ফেরত দেয়নি ডিপিই। আর এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো এবার ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকের বইয়ের কাজ নিয়েও না করার কথা জানিয়ে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আনন্দ প্রিন্টার্স, পিপার প্রসেসিং ইত্যাদি অন্যতম। তারা সব মিলে ১৩ লটের কাজ ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ এই স্তরে কাজই সব মিলে ৯৮ লট।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, বই ছাপানোর জন্য লোডশেডিং বড় সমস্যা নয়। শিক্ষামন্ত্রী মুদ্রণপাড়ায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারবেন হয়তো। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের কথা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কাগজ পাবেন কোথায়? দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ কাগজ আছে তাতে সর্বোচ্চ ৩০-৪০ শতাংশ বই ছাপানো সম্ভব হবে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ উৎপাদন করে তিনটি পেপার মিল। তাদের কাছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদনের পাল্প আছে। আর ৩৩ কোটি বই ছাপাতে লাগবে ১ লাখ মেট্রিক টনের বেশি কাগজ লাগবে। এখন কাগজ না থাকলে কী করে বই ছাপা হবে। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাদেরকে ১ লাখ টাকা করে কাগজ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তার এই অনুরোধ বাস্তবায়িত হবে কি না সেই প্রশ্নের জবাব কে দেবে। বাজারে এখন পর্যন্ত কাগজের দাম কমেনি। তাই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে বিদেশ থেকে কাগজ বা ভার্জিন পাল্প শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া। কিন্তু সেই পদক্ষেপ এখনও নেই। আর এখন যদিও বিনা শুল্কে কাছের দেশ ভারত থেকে পাল্প আমদানির সুযোগও পাওয়া যায়, তবু ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮০ ভাগের বেশি বই দেওয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং সব মিলে বই নিয়ে মহা সংকট অপেক্ষা করছে। তিনি আরও বলেন, এনসিটিবি শিক্ষামন্ত্রীকে ভুল বোঝাচ্ছে। এনসিটিবি নির্ধারিত সময়ের তিন মাস পর বই ছাপানোর কাজ শুরু করেছে। আর এখন আবার ভুল তথ্য দিচ্ছে। এসব কারণেই সমস্যা জটিল আকার ধারণ করবে।
প্রসঙ্গত, পাঠ্যবই নিয়ে এই শঙ্কা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অবগত। এ কারণেই কাগজ ব্যবসায়ী এবং প্রকাশক ও মুদ্রাকরদের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক করেছেন। শনিবারও রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক সভায় শিক্ষামন্ত্রীকে সামনে রেখে প্রকাশকরা পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে সংকটের কথা বলেছেন। যদিও জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি ১ জানুয়ারিই বই চাই। সময়মতো বই দিতে হবে।’
এদিকে অনেকেই প্রাথমিক স্তরের বই নিয়ে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রকেও দায়ী করছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) থেকে এই স্তরের বই ছাপানোর কাগজের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু সেখানকার সংশ্লিষ্ট শাখা রহস্যজনক কারণে কাগজের অনুমোদন আটকে দেয়। আর এ কারণে মুদ্রাকরদের মেশিনও চালু হচ্ছে না। তাদের আরও দাবি, পাঠ্যবই শিশুদের হাতে সময়মতো না গেলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। ডিপিইতে সুযোগ সন্ধানী কর্মকর্তাদের একটি অংশ এই কৌশল নিয়েছে। এ কারণে অন্যান্য বছর এই সময়ে যেখানে প্রাথমিক স্তরের অর্ধেকের মতো বই উপজেলায় পৌঁছে যায়, সেখানে এবার এখন পর্যন্ত একটি বইও ছাপানো হয়নি। আর এই সংকটের জন্য ডিপিইর পাঠ্যবই মুদ্রণ সংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির সদস্য মাহফুজা খাতুনকে দায়ী করেছেন। প্রায় এক যুগ পর্যন্ত একই পদে কর্মরত এই কর্মকর্তার কারণে কাগজের অনুমোদন ঝুলে আছে। অন্যান্য বছরও তিনি একইভাবে মুদ্রণ কাজে বিঘ্ন ঘটাতেন বলে মুদ্রাকরদের অভিযোগ। অবশ্য রোববার এ প্রসঙ্গে তার দপ্তরে গেলে তিনি কথা বলতেই রাজি হননি। পাশাপাশি তিনি এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে উপ-পরিচালক ইমামুল হক বলেন, কাগজের ছাড়পত্র কিছুদিন আটকে থাকলেও এখন দেওয়া শুরু হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগগিরই বই ছাপানো শুরু করবেন মুদ্রাকররা।
জানা গেছে, এবারে পাঠ্যবই মুদ্রণ সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টির পেছনে আরও কয়েকটি কারণ আছে। এগুলোর মধ্যে আছে-এনসিটিবি কর্তৃক বিলম্বে মুদ্রণ সংক্রান্ত কাজ শুরু করা; ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের বই এখনও চূড়ান্ত না হওয়া; করোনা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে কাগজ উৎপাদন কম হওয়া, ভার্জিন পাল্পের সংকট ও কাগজের আকাশছোঁয়া মূল্য; ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ছাপাখানার কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া; গত বছর পাঠ্যপুস্তকের কাজ করা মুদ্রাকরদের জামানতের (মোট কাজের ১০ শতাংশ) অর্থ ডিপিইর আটকে রাখা এবং কিছু প্রতিষ্ঠানের কাজ নেওয়ার পরও চুক্তি না করে (কাজ) ফিরিয়ে দেওয়া।
নাম প্রকাশ না করে মুদ্রাকররা বলছেন, এনসিটিবি এবারে অনেক দেরি করে পাঠ্যবই মুদ্রণ কাজের প্রক্রিয়া শুরু করে। অন্যান্য বছর এই সময়ে যেখানে অর্ধেকের মতো বই মুদ্রণ শেষ যায়, সেখানে শনিবার বই মুদ্রণের চুক্তি শেষ করেছে মাত্র। আবার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের বই দিতে চেয়েছে। কিন্তু তড়িঘড়ি স্কুলে এর পাইলটিং বা পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। যে কারণে কোনো রকমে পাইলটিং শেষ করে বই লেখা শুরু করে। কিন্তু সেই কাজও এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কাগজের মহাসংকট, বর্ধিত দাম এবং ডিপিইর অসহযোগিতা।
অবশ্য বই নিয়ে সম্ভাব্য সংকটের শঙ্কা এখনও উড়িয়ে দিচ্ছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম। তিনি রোববার যুগান্তরকে বলেন, এবার যাকে প্রাথমিকের বইয়ের কাজ দেওয়া হয়েছে, তাকে মাধ্যমিকের কাজ দেওয়া হয়নি। আবার বই সরবরাহে আগে যেখানে ৯৮ দিন সময় দেওয়া হতো, এবারে সর্বনিু ৫০ আর সর্বোচ্চ ৭২ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছরই সংকটের কথা ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজ উঠে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘জামানতের টাকা যাতে ডিপিই ফেরত দেয় সেই লক্ষ্যে আমি আজই (রোববার) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। এছাড়া ডিপিই যাতে কাগজের ছাড়পত্র দেয় সেই বিষয়টিও প্রতিমন্ত্রীকে বলা হয়েছে। তাই মাধ্যমিকের মতো প্রাথমিকের বইও ছাপার কাজ শুরু হয়ে যাবে শিগগিরই।’