দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে আগামী সোমবার থেকে সাতদিনের জন্য সারা দেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। এ সময় জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আদেশ আজ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা হবে।
শুক্রবার রাতে সরকারের এক তথ্যবিবরণীতে এই কঠোর লকডাউনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এতে আরও বলা হয়, জরুরি পণ্যবাহী ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। শুধু অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসাসংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত যানবাহন চলাচল করতে পারবে। জরুরি কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে কেউ বের হতে পারবে না। তবে গণমাধ্যম এর আওতাবহির্ভূত থাকবে।
এদিন রাতে তথ্যবিবরণী দেওয়ার পাশাপাশি একই বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কালকে (আজ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন দেব। আগামী ২৮ তারিখ থেকে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ দেব। এরপর প্রয়োজন হলে সেটা আমরা বাড়াব। এটা কঠোরভাবে সবাই যেন প্রতিপালন করে সেজন্য বেশি কড়াকড়ি থাকবে। এটি নিশ্চিতে মাঠে পুলিশ-বিজিবি থাকবে। এমনকি সেনাবাহিনীও থাকতে পারে। মানুষ অপ্রয়োজনে বাইরে আসবে না, অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। তবে বাজেটসংক্রান্ত কার্যক্রম এনবিআর বা পেমেন্ট সম্পৃক্ত অফিসগুলো খোলা থাকবে। জরুরি পরিষেবা ইন্টারনেট, গণমাধ্যম ইত্যাদি খোলা থাকবে।’
প্রসঙ্গত, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বর্তমানে সীমিত আকারে লকডাউন চলছে। যা ১৬ জুন থেকে কার্যকর আছে। এটি ১৫ জুলাই পর্যন্ত বহাল থাকার কথা ছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সংক্রমণের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সারা দেশে ১৪ দিনের জন্য শাটডাউন (সব বন্ধ) দেওয়ার সুপারিশ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা এলো।
এদিকে দেশের করোনা পরিস্থিতির প্রতিদিনই অবনতি হচ্ছে। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রীতিমতো লাগামহীন। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জনের। আর শনাক্ত হয়েছে ৫৮৬৯ জন ও আক্রান্তের হার ২১ দশমিক ২২। একই সময়ে সর্বোচ্চ শনাক্ত (৮৩ শতাংশ) হয়েছে লালমনিরহাটে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে এসব তথ্য।
সূত্র আরও জানায়, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে রোগী আক্রান্তের হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২১ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ আক্রান্তের হার বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। একই সঙ্গে এক মাসের ব্যবধানে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৪৪১ জন থেকে বেড়ে ৬ হাজারে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এই সংখ্যাও বেড়েছে ৪ গুণের বেশি। এমন পরিস্থিতিকে ভয়াবহতার প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের অভিমত, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কঠোরতা প্রতিপালনে দেশের সবাইকে অংশ নিতে হবে। যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করবে তদের বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। এমনকি ভারতের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব নয় বলে মন্তব্য তাদের।
গত এক মাসের দেশের করোনা সংক্রমণের হার লক্ষ করলে দেখা যায়, ২৪ মে দেশে কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী শনাক্ত হন ১৪৪১ এবং সংক্রমণের হার ছিল ৮ শতাংশ। এরপর থেকে সংক্রমণের হার এবং শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করে। ২৬ মে শনাক্ত হয় ১৪৯৭ জন, আক্রান্তের হার ছিল ৯ শতাংশ; ২৮ মে শনাক্ত ১৩৫৮ জন, আক্রান্তের হার ৯ শতাংশ; ৩০ মে শনাক্ত ১৪৪৪, আক্রান্তের হার ১০ শতাংশ; ২ জুন শনাক্ত ১৯৮৮, আক্রান্তের হার ১০ শতাংশ; ৪ জুন শনাক্ত ১৮৮৭, আক্রান্তের হার ১০ শতাংশ; ৬ জুন শনাক্ত ১৯৭৬, আক্রান্তের হার ১৩ শতাংশ; ১২ জুন শনাক্ত ১৬৩৭, আক্রান্তের হার ১৪ শতাংশ; ১৪ জুন শনাক্ত ৩০৫০, আক্রান্তের হার ১৫ শতাংশ; ১৬ জুন শনাক্ত ৩৯৫৬, আক্রান্তের হার ১৭ শতাংশ; ১৮ জুন শনাক্ত ৩৮৮৩, আক্রান্তের হার ১৯ শতাংশ; ২০ জুন শনাক্ত ৩৬৪১, আক্রান্তের হার ১৬ শতাংশ; ২২ জুন শনাক্ত ৪৮৪৬, আক্রান্তের হার ১৯ শতাংশ; ২৪ জুন শনাক্ত ৬০৫৮, আক্রান্তের হার ২০ শতাংশ এবং ২৫ জুন দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৮৬৯ জন, এই দিনে আক্রান্তের হার ছিল ২১ শতাংশের বেশি।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ে ঢুকে পড়েছি। রোগটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, স্থানীয় সংক্রমণ চলছে। যদিও সংক্রমণের হার ধীরে ধীরে বাড়ছে, তবে এই হার শীর্ষ বিন্দুতে ওঠার আগেই সারা দেশে সব ধরনের যাতায়াত, যোগাযোগ বন্ধ রাখতে হবে। হাট-বাজার, দোকানপাট, শপিংমল অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে। যদিও মানুষের কষ্ট হবে। তবে দেশের মানুষকে বাঁচাতে কোরবানির আগেই সংক্রমণ কমিয়ে আনতে জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত ২৪ ঘণ্টার তথ্যে দেখা যায়, শুক্রবার ফরিদপুরে শনাক্তের হার ছিল ৫১ দশমিক ৫৭ শতাংশ, গাজীপুরে ৩৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, রাজবাড়ীতে ৩৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, বান্দরবানে ৪৮ শতাংশ, সিরাজগঞ্জে ৪১ দশমিক ৭৫ শতংশ, নীলফামারীতে ৪৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ, লালমনিরহাটে ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, চুয়াডাঙ্গায় ৭৫ দশমিক ৮২ শতাংশ, যশোর ও ঝিনাইদহে ৬১ শতাংশ, খুলনায় ৪৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, পিরোজপুরে ৪৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, হবিগঞ্জে ৩৮ দশমিক ৭১ শতাংশ।
দেশের সামগ্রিক করোনা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে এখনই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মানুষকে ঘরে থাকতে এবং মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে।
নয়তো করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। তিনি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে এ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং সরকারের নির্দেশনাগুলো ছিল সময়োপযোগী। কিন্তু শাব্দিক অর্থের সঙ্গে বাস্তবায়নের মিল থাকে না। ফলে উদ্দেশ্য সফল হয় না। অধ্যাপক নাজমুল বলেন, সম্মিলিতভাবে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের বিভাগীয় পর্যায়ে খুলনায় সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে রংপুর ও ঢাকায় ১৬ শতাংশ করে। এছাড়া বরিশালে ১৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ১২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১০ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে ৯ শতাংশ। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের সংক্রমণের হার ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮৭৮৮০৪ জন, এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছে ৭৯৭৫৫৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৩৯৭৬ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, দেশের দুটি জেলায় আরটিপিসিআর পরীক্ষায় কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজারের উপরে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ঢাকায় শনাক্ত রোগী ৩৩৫০২৬ জন এবং চট্টগ্রামে ৫০৫৯৯ জন। এছাড়া ১১টি জেলায় এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজারের উপরে পৌঁছেছে। এগুলো হলো-সিলেট, বগুড়া, রাজশাহী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, খুলনা ও কক্সবাজার। টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, বরিশাল, যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর ও দিনাজপুর নিয়ে ১১ জেলায় এ পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি মানুষ আরটিপিসিআর পরীক্ষায় কোভিড-১৯ পজিটিভ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন।
কঠোর থাকবে পুলিশ : সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া লকডাউনে কঠোর অবস্থানে থাকবে পুলিশ। লকডাউন কার্যকরে কাউকেই ছাড় দেবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম। গণমাধ্যমকে শুক্রবার রাতে ডিএমপি কমিশনার বলেন, গত লকডাউন চলাকালে অনেকেই বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিল। কিন্তু এবার তা হতে দেওয়া হবে না। মোড়ে মোড়ে থাকবে পুলিশের কড়া চেকপোস্ট।
কারণ দর্শানো ছাড়া চেকপোস্ট পার হয়ে কেউ যেতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, বিনা কারণে কেউ রাস্তায় বের হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পর বাসায় পাঠানো হবে। জরুরি কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে কেউ বের হতে পারবে না। গণমাধ্যম লকডাউনের আওতার বাইরে থাকবে।