মারুফ আহমেদ
মার্কিনীদের কাছে প্রেসিডেন্ট পদ খুব গুরুত্বপূর্ণ। পুরো আমেরিকা জুড়ে নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়ে যায়-জনপ্রিয় পদপ্রার্থীদের তুমুল কথার লড়াই। শুধু আমেরিকার জন্য বলব না, পুরো বিশ্ব তাকিয়ে রয়-কে হবেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট?
ইতিহাসের আলোকে বলতে গেলে, সেই ১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জ ওয়াশিংটন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট।
১৭৮৯ সাল থেকে একে একে ৪৬ টি নির্বাচন পেরিয়ে ২০২৪-এ এসে ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুখোমুখি হলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কমলা হ্যারিস বনাম রিপাবলিকান পার্টির ডোনান্ড ট্রাম্প। চলল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবারকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের উত্তেজনা চলছিল পুরো সপ্তাহ জুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পাশায়র অঙ্গরাজ্যের একটি ছোট্ট গ্রামে প্রথম প্রহরে শুরু হয় ভোটগ্রহণ।
৬ নভেম্বর ‘২০২৪ নির্বাচনের রেষ ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। চলতে থাকল ভোটগ্রহণ। ভোট গণণা। জমে গেল খেলা! চূড়ান্ত ভোটের ফলাফল কলোরাডো, কানেকটিকাট, ডেলাওয়্যার, ইলিনয়, ম্যাসাচুসেটস, মেরিল্যান্ড, নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক, রোড আইল্যন্ড, ভার্মন্ট অঙ্গরাজ্যে কমলার প্রাধান্য ছিল। আর আলাবামা, আরকানসাস, ফ্লোরিডা, ইন্ডিয়ানা, কেনটাকি, লুইসিয়ানা, মিসৌরি, মিসিসিপি, মন্টানা, নর্থ ডাকোটা, নেব্রাস্কা, ওহিও, ওকলাহোমা, দক্ষিণ ক্যারোলিনা, সাউথ ডাকোটা, টেনেসি, টেক্সাস, উটাহ, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়াইমিং অঙ্গরাজ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিল শীর্ষে। ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে জয়ের জন্য যেখানে প্রয়োজন ২৭০ ভোট, সেই চিত্রে কমলা হ্যারিসের ২২৬ আর ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৯৫! প্রায় ৪৭.৬% বনাম ৫০.৯%। ইলেকটোকরাল কলেজ ম্যাজিক ফিগারে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত জয়ী ঘোষণা করা হয়।
বলা হল: TRUMP VANCE Make America Great Again 2024. TRUMP 2024.
শুরু হলো- ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বাণী দেবার পালা।
আমেরিকার মিত্র দেশগুলোই যে সবার আগে শুভেচ্ছা দিবে। তা জানে বিশ্ব। ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি এক্ষেত্রে এগিয়ে। নেটোর প্রধান ও নেটোর মহাসচিব মার্ক রুটোও শুভেচ্ছা বার্তা দেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো, বিট্রিশ প্রধানমন্ত্রী কির স্টারমার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনের প্রেসিডেন্ট আরসালা ভন ডের লেন, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনী আলবানিজ, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পক্ষে শুভেচ্ছা দেন জুলফি বুখারি, ভারতের নরেন্দ্র মোদি, আর আমাদের অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভা.পুতিন কোন শুভেচ্ছা পাঠাননি। যেই দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে আছে পুতিন সেখানে অভিনন্দন পাঠানো থেকে পুরোপুরি বিরত সেটা স্পষ্ট।
এদিকে- বিশ্ব জনতার গুঞ্জণ থেমে নেই। থেমে নেই দেশি-বিদেশী টিভি কভারেজ। টকশোতে ট্রাম্প তুষ্টি নিয়ে আলোচনা পর্ব। মানুষ মাতোয়ারা। নিজেরাই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুগভীর চিন্তাবিদ। ভার্চুয়ালে যে যার মন্তব্য ছড়িয়ে দিলো-ট্রাম্প জিতলে ভারত, ইসরায়েল ও রাশিয়ার জন্য কি সুবিধা অপেক্ষা করছে! আমাদের নেটযোদ্ধারা তো যেন ওঁত পেতে আছে। কখন ট্রাম্প জিতে যায়। আর সাথে সাথেই ছুঁড়ে দিবে পোষ্ট। ট্রাম্প আসলে ভারতের জন্য সুবিধা হবে। আর এদেশের একপক্ষ জানে, ভারত মানেই আওয়ামীলীগ! সেটাই ঘটল। ট্রাম্পের বিজয়ে স্বেরাচার শাসকের দোসরা ঠিক এভাবেই পোষ্ট দেয়া শুরু করল!
অনেকে আবার চিন্তিত …
ট্রাম্পের বিজয়-ইস্যুতে কি মার্কিন নীতি অপরিবর্তিতই থাকবে? আবার কেউ কেউ আফসোসে মরছে কমলা হ্যারিসের জন্য। কমলা জিতলে ইসরায়েল কি লাভবান হতো? এ নিয়ে খুঁনসুঁটি। এদিকে রাশিয়া হয়ে আছে আরও বড় একটা ইস্যু হয়ে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য সংকট। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ। এই বিষয়গুলো নিয়েও কাজ করার সুযোগ আছে দ্বিতীয়বার সুযোগ পাওয়া এই বর্ষীয়ান আমেরিকানের। তবে বিশ্ব জানে, ইসরায়েল বিষয়ে কমলা-ট্রাম্প দুজনই ইসরায়েলের ভাল বন্ধু। চট করে কেউ-ই ইসরায়েল ইস্যুতে মার্কিন নীতি থেকে সরে আসবে না। আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের নীতিও থাকবে শীতল। এর কারণটা আমরা জানি-২০১৬ তে প্রথমবার ট্রাম্পের বিজয়ের পিছনে রাশিয়ারও অবদান ছিল। রাশিয়ার আইটি সেক্টর খুবই শক্তিশালী। রাশিয়া হ্যাকিং এন্ড ফেক নিউজে ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করেছিল বলেও আইটি সেক্টরে রাশিয়ার প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।
আমাদের দেশের বড় গুঞ্জণেও জড়িয়ে আছেন মিঃ ট্রাম্প। মার্কিন নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে স্বৈরাচারী হাসিনার পতন না হলে ট্রাম্প থাকাকালীন কেন হাসিনার পতন হলো না? আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানেই নাকি আমেরিকার অকুণ্ঠ সমর্থনেই শেখ হাসিনার বিদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়? ফ্যাসিবাদ আর ২৪ এর আন্দোলনের প্রেক্ষাপট-কি এখানে?
নাকি অন্যকিছু…
ইতিহাস তো অন্য কথা বলে। ১৯৭১ সালেও মার্কিন প্রশাসক যাদের পক্ষে কথা বলে, তারা প্রায় ৯৬ হাজার সৈনিকসহ স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পিতার পক্ষের সৈনিকদের কাছে কি আত্মসমর্পন করে নাই? এখন কথা হচ্ছে- ডোনাল্ডই তো মসনদে বসল। তো আওয়ামীলীগ সামনে কি কি সুবিধা পাচ্ছে?
আওয়ামীলীগের বহুল প্রচারিত যে সেলফীর বাজার গরম ছিল।
“শেখ হাসিনাকে ধরে আছে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর পেছনে উনার মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবিটিই কিনা এখন ভার্চুয়ালে আওয়ামী দোসরদের কাছে একটু হলেও যেন আশার আলো ছড়াবে।”
এখন দেখার বিষয় ভারত ট্রাম্প থেকে কি আওয়াজ পায়। আর শেখ হাসিনা মোদির পাশে থেকেই নিজের দলের জন্য কি কি সুবিধায় ভাগ বসাতে পারেন?
তবে কথা একটাই। অন্তবর্তী সরকার কি নিজের মেয়াদান্তেই স্বৈরাচারী হাসিনাকে গণহত্যাকারী হিসেবে প্রমাণ করে, দেশে এনে জনগণের আদালতে দাঁড় করাতে পারবেন কিনা?
দেখার তো অনেক কিছু এখনও রয়েই যাচ্ছে। জাতির অপেক্ষার প্রহরও বাড়ছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন; বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে ট্রাম্পের এই বিজয়। সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের একটি প্রধান দায়িত্ব চলছে ‘শ্বেতপত্র” প্রস্তুতি। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট থেকে আমাদের নিজস্ব দলিলটি কতটা প্রভাবমুক্ত হয়ে তৈরি হবে এটাও দেখার বিষয় হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে? নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে অন্তবর্তী সরকারের আগাম পরিকল্পনা বিষয়েও মার্কিন সিনেটরেরা নাক গলাবে কিনা, এই দিকটিও ফেলে দেয়ার মতো মনে হচ্ছে না। ট্রাম্প নিজেও জানেন, ড. ইউনূস নিজেই একজন প্রতিষ্ঠান। আর মানুষটির সাথে মার্কিনীদের সাথে হৃদ্যতার যে সম্পর্ক। সেটা বিনি সূতোর মালার মতো! একজন বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্টের চোখে বাংলাদেশ ও বর্তমান দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার প্রতি ট্রাম্প প্রশাসকের আস্থা পুরোপুরিই যে থাকবে, এটা অনুমেয়।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয়। মার্কিনীরা কেন ডোনাল্ডকে দ্বিতীয়বার সুযোগটা দিলো। আর কমলাকে কেন একটু পরখ করল না? মূলতঃ তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসেই তো নেই নারী নেত্রীর পদচারণ! এটাকে তারা তো পাশ কাটাতে পারেনি কোনকালে! আর ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটল। কোটি কোটি আমেরিকানদের ভোটে জয়যুক্ত হয়ে ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউজে বসার সুযোগ পেলেন। কেন এই জয়কে নাটকীয় বলা হচ্ছে তা সবাই জানে। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দী জো বাইডেন নির্বাচনের মাস খানেক আগে নাম সরিয়ে নেন। আর প্রচারণায় ট্রাম্পের অভিযানও সহজ ছিল না। বেচারাকে দুই-দু বার গুলি করা হয়। নেয়া হয় হত্যাচেষ্টা। সভ্য দেশে প্রেসিডেন্ট হতে গেলে যদি এই হয় কান্ড, তো বিশ্বের ছোট দেশগুলো নির্বাচনে কি করবে ? ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে মানুষটা যখন পরাজিত হয়েছিল। তখনও মার্কিন নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব আরও এক নাটক দেখেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজয় মেনে নেয়নি সহজে! বাইডেনের পুরো সময় জুড়েই ছিল ট্রাম্পের বিদ্বেষমূলক সমালোচনা। কিন্তু এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে ট্রাম্প জাতিতে আশ্বস্থ করেছেন এই বলে-“ দেশ ক্রমাগত ধ্বংসের পথে হাঁটছে, আমি চাই দেশকে আবারও মহান দেশে পরিণত করতে।” ট্রাম্পকে ভোট দেয়া আমেরিকানরা তাদের অর্থনীতি ও অভিবাসন ইস্যুর জন্যই মূলতঃ ট্রাম্পকে সবাই ভোট দিয়েছে।
তবে বিশ্বের যে যার প্রত্যাশায় ট্রাম্পকে খুশি করুক। ডোনাল্ড ট্রাম্প জানেন তাকে কি করতে হবে। বিশ্বব্যাপী যে অস্থিরতা। আর বিভিন্ন দেশের সাথে আমেরিকার যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক। এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য নতুন নতুন অনেক ক্ষেত্র তৈরি হবে। অনেক ফ্যাক্টর ইতিমধ্যেই হয়ে আছে। এখন চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে পারাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্যতম সুযোগ। নিজেদের আদর্শ ও মতাদর্শ থেকে কতটা বেড়িয়ে এসে ভিন্ন মতকে গ্রহণ করতে পারবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটাই দেখার অপেক্ষা সবার।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি