২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সকাল ৯:৪৮
২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সকাল ৯:৪৮

পদ্মা সেতু অপমানের প্রতিশোধ: সংসদে প্রধানমন্ত্রী

নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করে ফেলাকে অপমানের প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতু আমাদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে। পদ্মা সেতু সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক এবং অপমানের প্রতিশোধ। এই সেতু শুধু সেতু নয়, এটি প্রকৌশলজগতে এক বিস্ময়।

বুধবার (৮ জুন) একাদশ জাতীয় সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশনে ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে’ আনীত সাধারণ প্রস্তাব আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই একটা সিদ্ধান্ত। যখন আমরা সেতু করতে শুরু করলাম, সবার টনক নড়লো। সবাই সমীহ করতে শুরু করলো যে, না বাংলাদেশ পারে। এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমি বলেছি, যেদিন নিজের টাকায় করতে পারবো, সেদিন করবো। কিন্তু আমার দেশকে অপমান করে টাকা নিয়ে করতে হবে! আমাকে ভয় দেখানো হয়েছে, যদি এটা না হয় আপনার ইলেকশনের কী হবে? আমার কথা, জনগণ ভোট দেবে না, ক্ষমতায় আসবো না। ২০০১ সালে তো আমাকে আসতে দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বলা হলো— আমি, আমার বোন রেহানা, আমার ছেলে কেউ বাদ যায়নি। ড. মসিউর রহমান, আমাদের সচিব মোশাররফ, মন্ত্রী আবুল হোসেন এদের ওপর যে জুলুম তারা করেছে এবং যখন অসত্য অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দিলো, তখন আমরা বললাম আমরা নিজের টাকায় করবো।অনেকে বোধহয় ভেবেছিলেন এটা অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমরা করতে পারবো। এই আত্মবিশ্বাস আমার ছিল।

ড. ইউনূসের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি ড. ইউনূস বেআইনিভাবে ৭১ বছর পর্যন্ত এমডি পদে ছিল। তাকে কোন অপমান করা হয়নি বরং তাকে ব্যাংকের উপদেষ্টা এমেরিটাস হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে এমডি থাকতে হবে।

তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় গ্রামীণ ব্যাংককে আমরা ৪’শ কোটি টাকা দিয়েছিলাম। গ্রামীণ ফোনের লাভের টাকা ব্যাংকে যাওয়ার শর্ত ছিল কিন্তু তিনি তার একটি টাকাও ব্যাংককে দেয়নি। বরং গ্রামীণ ব্যাংকের যত টাকা সব কিন্তু তিনি নিজে খেয়ে গেছেন। না হলে একজন ব্যাংকের এমডি এত টাকার মালিক হয় কীভাবে? দেশে-বিদেশে এত বিনিয়োগ করে কীভাবে? ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে লাখ লাখ ডলার কীভাবে অনুদান দেয়? কার টাকা দিল? কীভাবে দিল-সেটা তো কেউ খোঁজ নিলো না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশের পর ইউনূস বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করলো। কিন্তু প্রত্যেকটি মামলায় হেরে গেলো, কারণ আইন তো তাকে কাভার দিতে পারে না। আইন তো কারো বয়স কমাতে পারে না। হেরে গিয়ে আরও ক্ষেপে গেল। হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে আমাকে ফোন করিয়েছে। টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারকে দিয়ে ফোন করিয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি আসলেন সবার কথা ইউনূসকে ব্যাংকের এমডি রাখতে হবে।

তিনি বলেন, জাতির কাছে প্রশ্ন করছি— ব্যাংকের এমডির পদে কী মধু ছিল যে ওইটুকু উনার না হলে চলতো না। সে তো নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। নোবেল প্রাইজ যে পায় সে একটি এমডি পদের জন্য এত লালায়িত কেন? সেটা সবার চিন্তা করে দেখা উচিত।

শেখ হাসিনা বলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যেন টাকাটা বন্ধ করে তার জন্য বার বার ইমেইল পাঠানো, হিলারির সঙ্গে দেখা করা, তাকে দিয়ে ইমেইল পাঠানো; এবং তার সঙ্গে আমাদের একজন সম্পাদকও ভালোভাবে জড়িত ছিলেন। আমার প্রশ্ন এদের মধ্যে কী কোন দেশপ্রেম আছে?

তিনি বলেন, এত চাপ! এই মামলা নিয়ে যেসমস্ত খেলা। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি। কার ডায়রিতে লিখে রাখতে হলো— ডিডটা হলে পরে অমুক এত পারসেন্ট, অমুক এত পারসেন্ট। এখানে মসিউর রহমান সাহেবের নাম, রেহানার নাম, নিক্সনের নাম। তারপর আমাদের আবুল হোসেনের নাম, সচিবের নাম। সবার নাম দিয়ে পারসেনটেজ লিখে রেখেছে। আমি যখন ডিমান্ড করলাম আমাকে কাগজ দাও। আমি দুর্নীতির এভিডেন্স চাই। একটা ডায়রির কাগজ। পেনসিল দিয়ে লেখা। সেখানে তারিখ নেই। কিছু নেই। কোথায় বসে লিখেছে। এটা নাকি ওয়েস্টিন হোটেলে বসে লেখা। আমি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আমেরিকানদের জবাব দিয়ে বলেছিলাম— হ্যাঁ, আমার সাথে তো হিলারি ক্লিনটন দেখা করতে এসেছিল, এই এই কোম্পানিকে কাজ দিন। এবং ওই ওই কোম্পানিকে কাজ দিলে এত পারসেন্ট পাবে, আমার ডায়রিতে লেখা আছে। দেবো বের করে। তখন চুপ হয়ে গেছে। একজন আন্ডার সেক্রেটারি এসে খুব হুমকি-ধমকি। অ্যাম্বাসেডর এসে বার বার অফিসারদেরকে হুমকি দিতো। ইউনূসকে এমডির থেকে বের করলে পদ্মার টাকা বন্ধ করা হবে। বুঝি না একটা এমডির পদের জন্য একটা দেশের এতবড় ক্ষতি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করা। আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে দোষ দিচ্ছি। কিন্তু এই ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে দিয়ে তো এটা করানো হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তার শেষ কর্মদিবসে এটার টাকা বন্ধ করে দিয়ে যায়। তারপর তাদের চাপ এলো- অমুককে গ্রেফতার করতে হবে, অমুককে অ্যারেস্ট করতে হবে, অমুককে বাদ দিতে হবে— তাহলে আমরা টাকা দেবো। কিন্তু আমি বলেছিলাম, আমার কোনো অফিসারকে এই অপমান করতে দেবো না। মসিউর রহমান ও আবুল হোসেন সাহেবকে গ্রেফতার করতে হবে। মোশাররফ সাহেবকে গ্রেফতার করিয়েই দিলো। কিন্তু আমি বললাম— এটা করতে দেবো না। কারণ কোনো টাকা ছাড় হয়নি, দুর্নীতিটা হলো কোত্থেকে। আমি তো তাদের কাছে এভিডেন্স চেয়েছি কিন্তু তারা তো দিতে পারেনি। একটা কাগজও দিতে পারেনি। তাহলে তাদের এই অপবাদ আমরা নেবো কেনো?

তিনি বলেন, একটি মানসিক যন্ত্রণা আমার পরিবারের ওপরে। আমার মেয়েটাকে, আমার ছেলে, আমার বোন— তাদের ওপর যে মানসিক চাপ। জয়কে নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলছে— তোমার মাকে বলো না হলে তোমার বিরুদ্ধে অডিট হবে। সে বলেছিল, হ্যাঁ করো। আমার মাকে এটা বলতে পারবো না। আমার বিরুদ্ধে যত এনকোয়ারি আছে করতে পারো। আমি এখানে কোনো অন্যায় করিনি। আমার সবকিছু লিগ্যাল। আমি কোনো ভয় পাই না। কাকে না তারা চাপ দিয়েছে! শুধু আমার ওপরে? সবার ওপরে। এ রকম অবস্থাতে আমি কিন্তু দমে যাইনি। সততা আমার শক্তি। আমার শক্তি বাংলাদেশের জনগণ। এই জনগণকে অপমান করে কোন কিছু করবো? এটা নয়। এই একটা সিদ্ধান্ত। যখন আমরা সেতু করতে শুরু করলাম, সবার টনক নড়লো। সবাই সমীহ করতে শুরু করলো। যে না বাংলাদেশ পারে। এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, আমরা সেই অবস্থার থেকে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি। নিজেদের অর্থায়নে করবো বলেছিলাম। আমরা সেটা করতে পেরেছি।

পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রেললাইন কেনো করলাম সেটা নিয়েও আমাদের অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন। এই সেতুর দরকারটা কী ছিল— এই কথাটাও কেউ কেউ বলেন। যখন নির্মাণ কাজ শুরু করি অনেক জ্ঞানী-গুণী বলেছিলেন— হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে কিন্তু সেতু সম্পন্ন করতে পারবে না। তাদের কেউ কেউ আমাদের সরকারের সাথেও ছিলো। কত রকমের কথা এখানে শুনতে হয়েছে। আর এর একটাই কারণ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ছাড়া কিছু করা যাবে না। তাদের খবরদারি ছাড়া কোন কিছু হবে না। আর বাংলাদেশের কোনো উন্নতি হবে না। আমাকে এটাই বুঝানোর চেষ্টা হয়েছে। আমি বলছি না, আমি মানি না। আমরা পারবো। আর যদি পারি করবো। না পারলে করবো না।

তিনি বলেন, আমি বলেছি— পদ্মা সেতু করবো না। যেদিন নিজের টাকায় করতে পারবো সেদিন করবো। কিন্তু আমার দেশকে অপমান করে টাকা নিয়ে করতে হবে! আমাকে ভয় দেখানো হয়েছে— যদি এটা না হয় আপনার ইলেকশনের কী হবে। আমার কথা জনগণ ভোট দেবে না, ক্ষমতায় আসবো না। ২০০১ সালে তো আমাকে আসতে দেওয়া হয়নি।

এ সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান শেখা হাসিনা।

এর আগে প্রস্তাবটি আনায় সরকার দলীয় চিফ হুইপকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেওয়ায় সরকারি দল, বিরোধী দল সহ সকল সংসদ সদস্যকে ধন্যবাদ জানান সংসদ নেতা।

Facebook
Twitter
LinkedIn