২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সন্ধ্যা ৬:৫২
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সন্ধ্যা ৬:৫২

পরিবারের পিঠা উৎসব হোক ভয়হীন ভেজালমুক্ত

ক্ষেতের নতুন চাউল। আর গুড় নারকেল। সব যোগানো শেষ। শুরু হয়ে গেছে পিঠাপার্বন। গ্রামের বাড়ি বাড়ি পিঠা উৎসবের ধুম। শহরের বিষয় আলাদা। ছেলেবুড়োকে নিয়ে পিঠা করে খাওয়ানো গৃহিনীর সংখ্যা খুব কম। চাউল আর নারকেল, সাথে নিজের বাড়ির খেজুরের রস থেকে গুড় মিশিয়ে পিঠা করে সবাইকে নিয়ে পিঠা উৎসবের সৌভাগ্য- কম পরিবারের কপালেই জুটে। সে গ্রামে হোক কি শহরে। নিজের জমিনের চাউল আর গাছের নারকেল পাওয়া যায়। খেজুর গাছ আর রসের তৈরি খেজুরের গুড় খুব সহজে পাওয়া দুস্কর। আর শীতকাল আসা মানেই, দেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, খেজুরের গুড়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। 

শহরবাসীর জন্য খেজুরের গুড় খুব জনপ্রিয় ও উপাদেয় একটি খাবার। আর যদি আসে শীতকাল। সে তো কথাই নেই। আমরা অনেকেই শীতের এক নম্বর খেজুর গুড় সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ঢাকার বাইরের অঞ্চলে খোঁজ খবর নেই। কোন এলাকার গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহ করে পিউর খেজুরের গুড় তৈরি করছে। কিন্তু সবাই তো সেই মাধ্যমটা সম্পর্কে অবগত নন। এই বিষয়টি নিয়ে অনলাইনেও মানুষের খাবারের ইচ্ছেটাকে পুঁজি করে এখন ডিজিটালি ব্ল্যাকমেইল করছে। সবাই তারা ভাল ও খাঁটি খেজুরের গুড় ডেলিভারীর কথা নিয়ে মুখরোচক বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এসব অসাধু প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে গ্রাম ও শহরের অনেক প্রকৃত উদ্যোক্তা আজ তাদের সঠিক পন্য নিয়ে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। আবার যারা অনলাইনে খাঁটি গুড় তলব করছেন। তারাও হচ্ছেন প্রতারিত।

প্রকৃতপক্ষ্যে ঢাকার বাজারগুলোতে শীতের আগেই খেজুরের গুড়ের নাম করে, দোকানে পাটালি ও গোলাকার খেজুরের ছোট বড় চাকতি গুড় দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। কেউ কেউ প্লাস্টিক বক্সে আবার খেজুরের জোলা গুড়ও সাজিয়ে রেখেছে থরে থরে! রুটি দিয়ে জোলা গুড়ের সৌখিন খাদকও যে আছে শহরে। এটা একশ্রেণীর অসাধু গুড় বিক্রেতা ঠিকই জানে। প্লাস্টিক বক্সে এত সুন্দর ভাবে জোলা গুড় সাজিয়ে বেশ দামও কেটে নিচ্ছে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে।

অবাক করার বিষয়! কার্তিক অগ্রাহণের আগেই এখন খেজুরের গুড় বাজারে চলে আসছে। অথচ খেজুরের গুড় কিন্তু শীতকালের একটি ঐতিহ্যের নাম। ওসব গুড়ের বেশিরভাগ ভেজাল গুড়। প্রকৃত গুড় চাষীরা জানান, “অগ্রহায়ন থেকে পৌষ মাঘ পর্যন্ত আমরা খেজুরের রস থেকে গুড় করে সারা বাংলাদেশে খাঁটি গুড় চালান দিয়ে থাকি।” দেশের ফরিদপুর, যশোহর, রাজশাহী, নাটোর ও উত্তরের আরও বেশকিছু জেলা থেকে খেজুরের গুড় ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় বিক্রি হয়। বাজারে এখন খেজুরের গুড়ের দাম দুইশত টাকা থেকে তিনশত টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। জোলাগুড়ের কেজি তিনশত টাকা। আর একটু ভাল বলে যেটা বিক্রি করছে, সেগুলো আড়াইশো থেকে তিনশতটাকার মধ্যেই। একশত আশি টাকায়ও খেজুরের গুড় পাওয়া যাচ্ছে। বিক্রেতারা বলেন, “শীতের ভাপা পিঠার মৌসুম চলছে। বাড়ির লোকের চেয়ে ঢাকার স্ট্রিটফুডের পিঠাওয়ালারাই এখন সবচেয়ে বড় খদ্দের। অনেক স্ট্রিট ফুডের চা বিক্রেতারাও খেজুরের গুড়ের চা বিক্রি করছে ইদানীং। গুড়ের চা জনপ্রিয় বিধায় পিঠা ছাড়াও খেজুরের গুড়ের কদর আছে ঢাকায়। আর সামনে মাহে রমজান। তার আগেই খেজুরের গুড়ের মৌসুম শেষ হয়ে যাবে। তখন খেজুরের গুড়ের দাম বাড়লেও অনেকে সেহেরির খাবারে দুধভাতের সাথে খেতে, খেজুরের গুড় কিনে, ফ্রিজে স্টক করে রাখবেন।” তবে, নকল গুড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে জনৈক বিক্রেতা স্বীকার করেছেন, “সিজনের আগে কিনলে তো আসল গুড়ের মজাটা স্যার পাবেন না।”

কমদামের গুড় কিনতে গিয়েও ইদানীং অনেকে নকল খেজুরের গুড়ের পিঠা খেয়ে বসে আছেন। মাত্র দেড়শত টাকায় এক কেজি খেজুর গুড় নিয়ে এসেছিলেন- জনৈক এক গৃহিনীর দেবর।  ননদ এসেছে বেড়াতে। তাকে খেজুরের গুড়ের শীতের ভাপা পিঠা খাওয়াবেন এই ভাবনায়। মজার কান্ড! পিঠা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু শীতের খেজুরের গুড়ের যে গরম ধোঁয়া বের হওয়া ভাপা পিঠার স্বাদ। তার এক আনাও পাওয়া যায়নি এই পিঠায়। খেজুরের গুড় তো দুরের কথা। উনার দেবরকে দোকানী নাকি কেমন ধরনের গুড় ধরিয়ে দিয়েছে। না আখের গুড়। না তালের গুড় ! অনেক লোভী ও ধুরন্ধর বিক্রেতা সারা বছরের অবিক্রিত আখের, তালের গুড়ও মানুষকে খেজুরের গুড়ের সাথে মিক্সড করে প্যাকেটে ভরে দিচ্ছে। শীতের পিঠার মৌসুমের সুযোগ নিয়ে অসাধু বিক্রেতারাই মূলতঃ এসব করছে।

বাজার সয়লাব ভেজাল গুড়ে। এ কথাটিও তাই পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কদিন আগেও আমরা দেখেছি, নকল পাটালি গুড় কিভাবে তৈরি করা হয়? চার পাঁচ কেজি চিনি আর গরুর লালি মিক্স করে এসব ফটকা কারবারীরা খেজুরের পাটালি গুড় তৈরি করত? পুলিশের কাছে এসব ধোকাবাজ গুড়চাষীরা আটকও কিন্তু হয়েছে?

শীত ছাড়া ১০০ টা গাছ থেকে গুড় পাওয়া যায়, দশ-পনের কেজি। আর শীতকালে সমপরিমাণ গাছেই গুড় পাওয়া যায়, প্রায় পঞ্চাশ কেজি। কোন কোনও গাছে আরও বেশি। খেজুরের গুড়ের জন্য আমরা শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি না বলেই, অসাধু চাষী ও বিক্রেতারা দুই নম্বরী করার সুযোগটা পায়। শীত না আসতেই খেজুরের গুড় সরবরাহের অর্ডার পেলে তারা তো গরুর লালি দিয়ে তৈরি নকল খেজুরের পাটালি গুড়ই আমাদের খাওয়াতে চাইবে?

শীতও চলে এসেছে। এবার আসল গুড়ও চলে এসেছে। এখন হয়ত আর ততোটা ভেজাল গুড়ের সুযোগ নেই। খেজুরের গুড় মুখে নিলেই বোঝা যাবে, কোনটা আসল ও খাঁটি। ভাল ও বিশ্বস্থ বিক্রেতা সেটা আমার আপনার চেয়ে ঢের ভালই বুঝেন। সেই প্রক্রিয়াটা শিখেই ঢু মারুন বাজারে। ঘরের সবাইকে নিয়ে পিঠা উৎসব হোক আনন্দের। খাঁটি খেজুর গুড়ে। তবে ভুলে গেলে চলবে না। আগামী শীতের প্রারম্ভে আমরা অবশ্যই সতর্ক থাকব।

মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি

Facebook
Twitter
LinkedIn