গত বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের বিনিয়োগের তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে প্রেরণের একটি নির্দেশনা জারি করেছে। কিন্তু পুঁজিবাজার ইস্যুতে নির্দেশনাটি জারি করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লংঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জারি করা ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, পুঁজিবাজারে প্রভাব ফেলতে পারে এমন যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাথে আলোচনা করে নিতে হবে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের তথ্য দৈনিকভিত্তিতে জমা দেওয়া সংক্রান্ত নির্দেশনাটি জারির ক্ষেত্রে বিএসইসির সাথে কোনো আলোচনাই করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
পুঁজিবাজার সংক্রান্ত ইস্যুতে শুধু এবারই নয়, বিএসইসিকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর আগেও এই ধরনের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাজার অস্থির হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। আর তোপের মুখে পড়েছে বিএসইসি ও দুই স্টক এক্সচেঞ্জ।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও এর সহযোগি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর নির্দেশে ক্ষুব্ধ ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তারাও।
ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো, সহযোগী প্রতিষ্ঠানে মানে হচ্ছে সেটি আলাদা একটি সত্ত্বা। পুঁজিবাজারে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য জানানোর প্রয়োজন হলে তারা তা সরাসরি প্যারেন্ট কোম্পানিকে (নিজ নিজ ব্যাংক) জানাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের কাছে সরাসরি তথ্য চাইতে পারে না। ব্যাংকগুলো তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে কী পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে, সেই তথ্য চাইতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সাবসিয়ারি কোম্পানিগুলো প্রতিদিন কী পরিমাণ টাকার শেয়ার কেনা-বেচা করছে, কী কী শেয়ার কিনতে সে তথ্য জানতে চাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এই ধরনের সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ পেলে কোনো বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না। এটি বাজারের স্থিতিশীলতা ও গতিকে ব্যাহত করতে পারে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করছে, পুঁজিবাজারসহ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ তদারকির লক্ষ্যে এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, মহামারি করোনার ক্ষতিপূরণ পুষিয়ে নিতে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য স্বল্প সুদে শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিয়েছে সরকার। সেই ঋণের বড় অংশই পুঁজিবাজারসহ অনুৎপাদনশীল খাতে চলে গেছে। এজন্য পুঁজিবাজারের ব্যাংক এবং ব্যাংকগুলোর সহযোগি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ তথ্য প্রাপ্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে।
কিন্তু বিষয়টিকে সংশ্লিষ্টরা পুঁজিবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলে মনে করছেন। এতে বাজারে ভুল বার্তা যেতে পারে এবং বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই ধরনের যে কোনো প্রজ্ঞাপন জারির আগে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাথে পূর্ব-আলোচনা করে নেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনা মানেনি।
উল্লেখ, ২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জারি করা অর্থমন্ত্রণালয়ের আলোচিত নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, পুঁজিবাজার বা তৎসংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষয় সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কোনো প্রজ্ঞাপন বা নীতি জারি করার আগে বিএসইসির সাথে আলোচনা, পরামর্শ ও সমন্বয় করতে হবে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, দুই স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, অর্থমন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পরিপালনের জন্যেই শুধু নয়; দেশের পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্যেও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে আলোচনা, পরামর্শ ও সমন্বয় প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক কোন কোন ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সকলে আশা করছেন, সবাই বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে সমন্বয় নিশ্চিত করবে এবং পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এমন সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা পুনর্বিবেচনা করবে।