ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পাঠানো ২০ লাখ ডোজ টিকা আজ বাংলাদেশে পৌঁছাবে। আর ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে সরকারিভাবে কেনা করোনার টিকার প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ আসবে ২৫শে জানুয়ারি। টিকা হাতে আসার পর ২৭ অথবা ২৮শে জানুয়ারি ঢাকায় প্রথমে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হবে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করোনার টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনের পরবর্তী দিনে ড্রাই রান অর্থাৎ পরীক্ষামূলক হিসেবে ঢাকায় ৪টি হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে এই টিকা দেয়া হবে। কেনা টিকার প্রথম চালান ও উপহারের টিকা মিলিয়ে প্রথম মাসে আসবে ৭০ লাখ ডোজ। প্রতিদিন দুই লাখ ডোজ হিসেবে প্রথম মাসে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এরপর দেশব্যাপী ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হবে।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান। এসময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজিবিষয়ক) জুয়েনা আজিজ, আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম উপস্থিত ছিলেন।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বলেন, এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিশেষ ফ্লাইটে বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় উপহারের ২০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসবে।
সেখান থেকে নিয়ে টিকা রাখা হবে তেজগাঁওয়ে ইপিআইয়ের স্টোরেজে। বাংলাদেশ সরকারিভাবে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ৩ কোটি ডোজ কিনছে। আর ভারত সরকার উপহার হিসেবে যে টিকা পাঠাচ্ছে, সেটাও সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ডের টিকা।
আব্দুল মান্নান বলেন, কেনা টিকার প্রথম চালান ও উপহারের টিকা মিলিয়ে প্রথম মাসে আসবে ৭০ লাখ ডোজ। প্রতিদিন দুই লাখ ডোজ হিসেবে প্রথম মাসে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা তারা নিয়েছেন। টিকা হাতে আসার পর ২৭ অথবা ২৮শে জানুয়ারি ঢাকায় প্রথমে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হবে। ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে প্রাথমিকভাবে এই টিকা দেয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্যসেবা সচিব। তিনি জানান, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী এক সপ্তাহ অপেক্ষা করা হবে। এরপর টিকা দেয়া হবে সারা দেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।
রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন হবে। প্রথম দিনে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অর্থাৎ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার ২০ থেকে ২৫ জন নাগরিককে টিকা দেয়া হবে। তাদের মধ্যে ডাক্তার, নার্সসহ ফ্রন্ট লাইনে যারা কাজ করছেন তারা তো থাকবেনই- এ ছাড়া শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতিনিধি থাকবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তৃতা দেবেন। স্বাস্থ্য সচিব জানান, আপাতত কুর্মিটোলায় উদ্বোধন করার প্রাথমিক পরিকল্পনা থাকলেও চূড়ান্তভাবে যেকোনো হাসপাতালে তা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি প্রদান সাপেক্ষে চূড়ান্ত দিনক্ষণ ও স্থান নির্ধারিত হবে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করোনার টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনের পরবর্তী দিনে ড্রাই রান অর্থাৎ পরীক্ষামূলক হিসেবে চারটি হাসপাতাল ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সচিব জানান, সম্ভাব্য আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে উপজেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হবে। পরবর্তীতে সারা দেশে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সম্পন্ন হয়েছে। টিকা সংরক্ষণের জন্য উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কোল্ড স্টোরেজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখনই বেসরকারি পর্যায়ে টিকা দেয়া হবে না।
দেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনের এই সংখ্যা যথেষ্ট কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, বাড়তি জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিন আনার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে। কোভ্যাক্স থেকে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হিসাবে ৬ কোটি ৮০ লাখ ভ্যাকসিন আসবে। ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ দেয়া হবে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে। আর ভারত থেকে কিনে আনা ৩ কোটি ডোজ দেয়া হবে এক কোটি ৫০ লাখ মানুষকে। তাতে করে ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ এই দুই সোর্স থেকে আসা ভ্যাকসিন পাচ্ছেন। সঙ্গে রয়েছে উপহারের ২০ লাখ। এই হিসাবে মোট জনসংখ্যা হয় ৫ কোটির বেশি। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি হচ্ছে যেন নিদেনপক্ষে দেশের ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া যায়, সে চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যদি দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়া যায়, তাহলে সে দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। আমাদের মাইক্রো প্ল্যানে এই ৮০ শতাংশ মানুষকেই টিকা দেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। মোট ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার পরেও যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আরো টিকা আমদানি করা হবে। একইসঙ্গে আমি অত্যন্ত আশাবাদী, আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে আমাদের দেশেই ভ্যাকসিন তৈরি হবে এবং এটা অ্যাভেইলেবেল হয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব। তিনি জানান, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে টিকাদান কেন্দ্র পর্যন্ত সব স্তরে টিকার নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ভ্যাকসিন সেল গঠন করা হয়েছে। সেখান থেকে আপডেট জানা যাবে প্রতিদিন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার অরজিনাল টিকাই বাংলাদেশে আসছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া সংস্কার টিকা নয়। নকল ভ্যাকসিনের আশঙ্কা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সুযোগই তো রাখা হয়নি। বড় বড় হাসপাতালগুলো টিকার আবেদন করেছে। তাদের এখনো অনুমোদন দেয়া হয়নি। তাদেরকে ২০টি শর্ত দেয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম জানান, করোনার টিকাদানের জন্য সুরক্ষা অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। এটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ২৩শে জানুয়ারি শেষ হবে। এরপর অ্যাপসটি ২৫শে জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তিনি আরো জানান, অ্যাপসটি তৈরি করতে কোনো অর্থ খরচ হয়নি। তবে ভবিষ্যতে এটির হোস্টিং এবং রক্ষণাবেক্ষণে সামান্য অর্থ প্রয়োজন হবে। এসএমএস-এর মাধ্যমে মানুুষকে নিবন্ধনের কেন্দ্র ও সময় জানানো হবে।
কারা টিকা নিতে পারছেন না- এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে তারা টিকা নেবেন না। ক্যান্সার রোগী যারা এন্টি ক্যান্সার ওষুধ নিচ্ছে, ১৮ বছরের নিচে এবং গর্ভবতী মায়েরা টিকা পাচ্ছেন না। তিনি আরো বলেন, যেকোনো টিকার কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। যেমন-মাথা ঘুরানো, জ্বর আসা, বমি বমি ভাব, ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। তবে এই টিকার বড় কোনো সমস্যার খবর এ পর্যন্ত আসেনি। এই টিকার কার্যকারিতা কতোদিন জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, বিশ্বে এই টিকা এত দ্রুত এসেছে। যার ফলোআপ দীর্ঘ সময় হয়নি। ফলে এর কার্যকারিতা কতোদিন কেউ জানে না। টিকাদান কেন্দ্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলেও জানান ডিজি।