আসছে নতুন দিন। নতুন বছর। ইংরেজী নববর্ষ। হ্যাপি নিউ ইয়ার-২০২৪। প্রভাত পেরুলেই বিদায়ী হতাশার গ্লানি ভুলে আমরা নতুন স্বপ্নে জেগে ওঠব। সোমবারের ভোরের আলোর মতো। আশা-ভরসার মনের ফানুস জ্বালব। ২০২৩ বিদায় জানাতে আগুনের ফানুস উৎসবে মেতে মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটাব না আমরা।
২০২৩ বছরটি দেশে-বিদেশে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আলোচিত বছর। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ও আমাদের বাংলাদের জন্য কেটেছে একটি উত্তপ্ত বছর। যুদ্ধ বিগ্রহ, পারস্পরিক সংকট, রোগশোক-মহামারী, ভুমিকম্প, বিশ্বব্যপী অর্থনৈতিক মন্দা, বিশ্বকাপ ক্রিকেট সব মাতিয়ে ছাপিয়ে চলে যাচ্ছে আজ বছরের শেষ দিন। আঞ্চলিক উত্তেজনা ও বিশ্বব্যপী রাজনৈতিক মেরুকরণের বছরও বলা যায় বছরটি। আর আমাদের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক অঙ্গন পুরো বছরটাই ছিল চরম উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। চীন আমেরিকার টানপোড়েন, ইমরানের পতন, নওয়াজের উত্থান, আমেরিকার ইসরাইলকে মদদ, হামাসের ইসলাইল আক্রমণ, ফিলিস্তিনের হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, বিশেষ করে শিশুমৃত্যুতে বছরের নজির ও মানুষের হৃদয়হরণ। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এই যুদ্ধের প্রভাব। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও তুরুস্কের বড় রকমের ভুমিকম্প থেকে আমাদের বাংলাদেশেও পরপর কয়েকবার ভুকমম্পন ছিল। যা নাগরিক জীবনের জন্য একটি অন্যতম সতর্ক বার্তা। বিশ্বব্যপী উষ্ণায়ন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় পেরিয়ে এবারই আমাদের স্থানীয় রাজনীতি একটু অন্যরকম মর্যাদা পেল। রাজনৈতিক আদর্শ, মতাদর্শ সব বিশ্ব দরবারের নজর কেড়েছে। আমাদের নিয়ে নাক গলিয়েছে এশিয়া ইউরোপ আমেরিকার মতো শীর্ষ দেশ, শীর্ষ নেতারা। এসেছে ভিসা নীতির মতো একটি অবিস্বরণীয় ঘটনা। বিনোদন জগতে হলিউড, বলিউড ঢালিউড ছাপিয়ে এসেছে ওটিটির জয়জয়কার। এসেছে ওয়েব সিরিজ বিনোদন জগতে নতুন দর্শক সৃষ্টির জোয়ার। ভারত প্রযুক্তির শিখরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হয়ে চাঁদে নভোচারী পাঠিয়ে দেখিয়েছে। আমরাও চন্দ্রাভিযানে উৎসাহিত হতে আগামীর অনুপ্রানিত জাতির খাতায় নাম লিখিয়ে অন্যদিকে দেখিয়ে দিয়েছি উন্নয়ন ও প্রযুক্তির দাপট। এ বছর আমরাও পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করেছি। দেশে প্রথম সাফল্য এটা। ইউরেনিয়ামের যুগে চলে এসেছে বাংলাদেশ। ধিরে ধিরে পারমাণবিক জ্বালানি শক্তির স্বর্ণশিখরে যাওয়ার প্রত্যয় আমাদের নিয়ে যাবে আরও অনেকদূর।
তবে আমরা সমালোচিত হয়েছি রাজনীতি নিয়ে। নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলে ওয়াকআউটে। ২৮ অক্টোবর দেশের সংহিস ঘটনা ও একজন পুলিশের মৃত্যু। এরপন নির্বাচন কমিশন। আর নির্বাচন বিষয়ক টানটান খবরাখবরে বিভ্রান্তিতে পড়ল জাতি। বিষয়: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন? যেই উত্তেজনা প্রশোমিত হলো দলগুলো প্রার্থী নির্বাচন। জাতীয় পার্টি নিয়ে আর শরিক দলের সাথে আওয়ামিলীগের বৈঠক আর বৈঠক। মাঠ গরম করল ডামি নির্বাচন কথাটিও। এরপর দলগুলোর যাচাই বাছাই থেকে অনেব নমিনেশন প্রার্থী বাদও পড়ল। আবার অনেক বাদ পরারা আবার সুখবর পেয়ে পৌঁছে গেল জনসমর্থনে আওয়ামিলীগের ইশতেহার হাতে নিয়ে জনতার বাড়িতে বাড়িতে। কি হবে না হবে এই সেই করেই সবার অপেক্ষার দিনক্ষন বেঁধে দিলো ইসি ৭ জানুয়ারি। এখন নিজেদের মাঠ গরম করেই চলছে দলটি। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী এখনও সচকিত দৃষ্টিতে অপেক্ষায় বসা। বছরের সর্বশেষ জনমত জরিপের একটি সেরা প্রশ্নও ছিল একটি : “ আপনার প্রতিদ্বন্দী কে, বিরোধী দল কে…” বছরের শেষ দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ইইউ’র এই প্রশ্নটি নিয়ে জনগণ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে পড়ে গেল একটি দ্বিধাদ্বন্দ ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন আকস্মিক প্রশ্ন নিয়েও শুরু হয়ে উত্তেজনা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসি যত যাই বলুক। এখন দেখার অপেক্ষা। ভোটের অপেক্ষা। উৎসবমুখর পরিবেশ আর জনতার ভোটের অধিকার কতটা মূল্যায়িত হয়। বিরোধীদল নেই। তৃণমূল বিএনপির নতুন আগমনি বার্তাও জনগনকে বছরটিতে নতুন চমক এনে দিয়েছে খবরের শিরোনামে। নায়ক ফেরদৌস ও মাহিয়া মাহির নির্বাচনে আসাও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য বিশেষ চমক। বিগত বছরগুলোকে পিছনে ফেলে সর্বোচ্চ মেগা প্রকল্পের ফিতা কাটার বছরও ছিল ২০২৩। মেট্টোরেল, টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দর টার্মিনালসহ আরও অনেক অনেক উন্নয়নে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছি আমরা। কিন্তু মনটা খারাপ করার বছরও কিন্তু ছিল এ বছর। খুব বেশি মনখারাপ। কেননা আমরা জানি ডেঙ্গু মহামারির কথা। সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার গাফিলতি, স্বাস্থমন্ত্রণালয়ের উপযুক্ত নজরদারির বছরও ছিল এটি। কেননা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও এই মরণ-ভাইরাসে আমরা বছরটিতে অনেক পরিবারের আপনজন হারিয়েছি। ডোবা নালা বাসা বাড়ির ছাদ, বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে অপরিস্কার পরিবেশে মানুষ ছিল দিশেহারা। সামান্য একটা ছোট্ট মশার ভয়েই কেটেছে মানুষের চরম আতঙ্কের দিনগুলি। প্রায় ৫ লাখ মানুষ এই ক্ষুদ্র মশার কামড়ে পৌঁছে গেছে হাসপাতাল। আর মৃত্যুর মিছিল তো পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে বছরটিতে। আগামী বর্ষার প্রারম্ভে কিন্তু সচেতন না হলে সরকারকে এই মহামারীর জন্য জনতার কাতারে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য শতভাগ লজ্জিত থাকতে হবে। দেশের পয়নিস্কাশন ও পরিবেশ সুন্দর করতে এই ডেঙ্গু আমাদের এ বছর কিন্তু বলা যায় চোখ খুলে দিয়ে গেলো। কবে বেশ অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা ছিল শিক্ষানীতির বিষয়টি। স্কুলে স্কুলে পাঠ্যদানের শিক্ষকদের মজার ট্রেনিং নেয়। ও নতুন শিক্ষা কারিকুলামের বিষয়টি।মানুষের অন্নের অধিকার ক্ষুণ্য করেছে এবছর দ্রব্যমূলের ঘোড়ার রেসের মতো দাম।পেয়াজ এবারও ভুগিয়েছে জাতিকে। ছাড়িয়ে গেছে ২০০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট। ছিল বছরের সবচেয়ে ফালতু একটি প্রপাগান্ডা। ভোক্তা অধিকার আইন ও বাণিজ্য মন্ত্রণায়ল পুরোই ব্যর্থ একটি বছর পাড় করেছে। জনগণ সম্পূর্ণ বিরক্ত ছিল সেটা কাচামরিচ, ডিম, আলু, চিনি, চাউল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের চরা দামই আমাদের বলে দিচ্ছে। আকাশছোঁয়াই বাকি ছিল। মানুষের পিঠ পুরোই দেয়ালে ঠেকে গেছে। বাসা বাড়িতে গ্যাসের শতভাগ সঙ্কট ছিল। এবং আছে। এ বছর প্রতিটা বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া সম্পূর্ণ টাকা সরকারকে গ্যাস বিল দিয়ে গেছে। কিন্তু গ্যাস এর উপকারিতা ভোগ করেছে শুন্য মাত্রায়। নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কারেরও খবর আমাদের যদিও চমকিতই করেছে। এখন দেখার পালা। আগামীতে বাসা বাড়িতে গ্যাস কতটা সুলভে গৃহিনীরা ভোগ করতে পারে। ডলার সংকট আমাদের রিজার্ভ ছিল কোনঠাসা। ডলারের চরা দাম। মানুষের নিম্ন বেতন ও জীবন যাত্রারমাণ খুব খারাপ পর্যায়ে নেমে এসেছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন আদায়ে পুলিশের সাথে একশ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও বিশ্বে আমাদের পোষাকখাত নিয়ে শঙ্কার উদ্বেগ ঘটায়। গ্রামীণ ব্যাংকের মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুও খুব আলোচিত ঘটনা ছিল বছরের। সমালোচিত ছিল মাত্রাতিরিক্ত দুর্ণীতির বিষয়টি। সরকারি পাবলিক সব কোটি কোটি হাজার কোটির মালিক বনে গেছে। দুর্নীতি প্রশাসনে বিরাজ করেছে বিদ্যুৎগতিতে। কালোটাকার মালিক করেছে রাতারাতি। সাধারণ মানুষ আর দেদার কামানোর মানুষের যে ফারাক তৈরি হয়েছে দেশে। এর সূত্রপাতের বছরও এই ২০২৩। দেশে বিদেশে আমরা বেশক’জন গুনী মানুষ হারিয়েছি বছরটিতে। হারিয়েছে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা। কেননা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য ছিল একটি লজ্জার বছর। ক্রিকেটমোদীরা কোচ ও নির্বাচক প্যানেলের বিষয়ে পুরোপুরি সমালোচনার আঙুল তুলেছে। তামিম ইকবালের বিশ^কাপ দলে জায়গা না হওয়া। বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার সাকিব আর তামিমের বিভেদ এবং সাকিবের খেলার মাঠ থেকে রাজনীতিতে প্রবেশ। নমিশেন নিয়ে আওয়ামিলীগের পক্ষে মাগুরা থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়া সবই কেমন যেন ফিকে করে দিচ্ছে খেলাপ্রেমী মানুষগুলোকে। তারপরও বছরে বাংলাদেশের নতুন ক্রিকেট দল নিউজিল্যন্ড গিয়ে ম্যাচ জিতে বছরটিতে একটু হলেও সবাইকে পুনরায় ক্রিকেটে ফিরিয়ে আনতে আশার আলো দেখাচ্ছে।সড়কে তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েয়ে লাগামহীন সড়ক দুর্ঘটনা।সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ছিল অবরোধের নামে বাসে আগুন, আর ট্রেন জ্বালিয়ে দিয়ে মা ও সন্তানকে পুঁড়িয়ে মেরে ফেলা! ট্রেনের লাইন কেটে নিয়ে হিংস্র অমানবিকতার রাজনীতি আমাদের পুরোপুরি লজ্জিত করল। রাজনীতির অঙ্গণ করল কলঙ্কিত। নোংরামী দূর করে রাজনৈতিক অঙ্গন হোক পরিচ্ছন্ন। মানুষের কল্যাণে। বিদায় তেইশ। ২০২৪ শুভহোক।
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি