বন্যায় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বাড়ছে বানভাসি মানুষের সংখ্যা। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বানের স্রোতে রাস্তাঘাট ও ব্রিজ ভেঙে যাতায়াতে বেড়েছে দুর্ভোগ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে বাড়িঘর ছেড়ে বাঁধের দিকে ছুটছে। কেউ কেউ বন্যামুক্ত এলাকায় স্বজনদের বাড়িতে ঠাঁই নিচ্ছে। অনেক এলাকায় ত্রাণ পৌঁছেনি।
নিম্নবিত্তরা এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা অনাহারে থাকছে। শুক্রবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১০টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর প্রভাবে বন্যায় তলিয়ে গেছে গেছে ১৫ জেলার নিম্নাঞ্চল, যার মধ্যে ১১ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।
বর্তমানে দেশের বন্যাকবলিত ১৫টি জেলা হলো- কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর। আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুরের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এছাড়া দেশের ১০ নদীর পানি ২২টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে দুধকুমার, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ঘাঘট, তুরাগ, পদ্মা, আত্রাই ও ধলেশ্বরী।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় আছে এবং বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এদিকে যমুনা নদী ও ধলেশ্বরীসহ বিভিন্ন নদীপাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রায় ৮০ কিলোমিটার অংশে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভারত থেকে প্রচণ্ড গতিতে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। পানির চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, বন্যার পানি বাড়তে থাকলে স্থানীয় জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়া দেশের ১১ জেলায় প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পাঠানো হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে- কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর।
ডা এনামুর রহমান জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ে গঠিত মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি নজরে রাখছে। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজন অনুযায়ী পরামর্শ করা হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়ায় উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও চররাজিবপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বসতভিটায় পানি প্রবেশ করায় লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে বাঁধ ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। তৃণভূমি তলিয়ে যাওয়ায় গবাদিপশুর তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করছে। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বাড়ায় এই অববাহিকায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে বলে জনপ্রতিনিধিদের সূত্রে জানা গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক জানান, বন্যার ফলে জেলায় প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর রোপা আমন, শাকসবজি ও বীজতলা তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানিয়েছেন, বন্যা দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরসহ তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার থেকে ২৮০ টন চাল ও ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দুর্গত এলাকায় বিতরণ শুরু হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে বগুড়া জেলার ৬৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বগুড়া জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, যমুনা নদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ৯৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে ৩৪৭ হেক্টর জমির ফসল। প্লাবিত হয়েছে ২৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দুর্গত এলাকায় ১৭০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাসেল মিয়া বলেন, যমুনায় পানি বাড়ায় উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ১২ হাজার ৭০০ পরিবারের ৫০ হাজার ৮০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকায় ৭০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তানদীর পানি শুক্রবার সকাল ৬টার দিকে বিপত্সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তার পানিবৃদ্ধি পাওয়ায় হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড। তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের ১৫টি গ্রামের ৭হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিরাজগঞ্জে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবন যাপন করছে। ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীতে বনার পানি আরও ৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল সকালে বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিষয়টি গতকাল নিশ্চিত করেছেন সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসেন ও জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আব্দুর রহিম।
আব্দুর রহিম জানান, বন্যায় ৫টি উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দূর্বিসহ জীবন যাপন করছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৫২১ মেট্রিক টন চাল এবং ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। শুক্রবার সকালে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টের গেজ মিটার (পানি পরিমাপক) আব্দুল লতিফ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার বেড়ে গতকাল সকালে বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।