ব্রীজ ভেঙ্গে বর যাত্রী নিয়ে মাইক্রো নদীতে।। ৯ জন নিহত।। ঠিকাদারের বিচার দাবীতে কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ।।
মো: মিজানুর রহমানব্রীজ নির্মাণকারী মিজান, বরগুনা প্রতিনিধি:-
বরগুনার আমতলী উপজেলা চাওড়া নদীর উপর নির্মিত হলদিয়া হাট ব্রীজ ভেঙ্গে বিয়ের নয় কনে যাত্রী নিহত হয়েছে। নিহতের মধ্যে এক পরিবারের তিনজন রয়েছে। অপর নিহতরা সকলেই পরস্পর আত্মীয়স্বজন। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্বজনদের আহাজারীতে আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা ব্রীজ নির্মাণ করেছে। ফলে নির্মাণের ৫ বছরের মাথায় ব্রীজের মাঝখানের ভীম ভেঙ্গে যায় ব্রীজ ভেঙ্গে বিয়ের কনে পক্ষের ৯ জন মারা যাওয়ায় বর ডাঃ সোহাগ ও কনে হুমায়রার বাড়ীসহ কনের নানা বাড়ীতে শোকের মাতম বইছে।
জানাগেছে, শনিবার দুপুর দেরটার দিকে আমতলী উপজেলা কাউনিয়া ইব্রাহিম একাডেমি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উত্তর তক্তাবুনিয়া গ্রামের মাসুম বিল্লাহ মনিরের মেয়ে হুমায়রা আক্তারের সঙ্গে একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমতলী পৌর শহরের খোন্তাকাটা এলাকার বাসিন্দা সেলিম মাহমুদের ছেলে ডাঃ সোহাগের বিয়ে হয়।
গত শুক্রবার ওই কনেকে বরের বাড়ী তুলে আনেন। শনিবার মেয়ের পক্ষের লোকজন বরের বাড়ীতে মাইক্রো এবং অটো গাড়ীতে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে হলদিয়া ব্রীজ পাড় হওয়ার সময় ব্রীজের মাঝের অংশ ভেঙ্গে যায়। এতে মাইক্রোবাস ও অটো গাড়ী নদীতে পড়ে যায়। অটোতে থাকা যাত্রীরা সকলে সাতরে কিনারে উঠতে পারলেও মাইক্রোবাসের যাত্রীরা নদীতে তলিয়ে যায়। তাৎক্ষনিক স্থানীয়রা ওই মাইক্রোতে থাকা লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী নাশির উদ্দিন। খবর পেয়ে আমতলী ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। ততক্ষণে মাইক্রোবাসে থাকা কনে পক্ষের ৯ যাত্রী নিহত হয়েছে। নিহতরা হলেন রুবিয়া (৪৫), রাইতি (২২), ফাতেমা (৫৫), জাকিয়া (৩৫), রুকাইয়াত ইসলাম (৪), তাহিয়া মেহজাবিন আজাদ (৭), তাসফিয়া (১৪), ঋধি (৪) ও শাহনাজ আক্তার রুবি বেগম (৩৫)। এদের মধ্যে রুকাইয়াত ইসলাম ও জাকিয়ার বাড়ী উপজেলার দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামে। অপর নিহত ৭ জনের বাড়ী মাদারিপুর জেলার শিবচর উপজেলার কোকরার চর গ্রামের বাসিন্দা। এরা কনে হুমায়রার মামা বাড়ীর আত্মীয়স্বজন।
এমন ঘটনায় বর ডাঃ সোহাগ ও কনের হুমায়রার বাড়ীতে শোকের মাতম বইছে। শনিবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে বর ডাঃ সোহাগের বাড়ীতে সুনসান নিরবতা। ডেক্সিভরা খাবার রয়েছে। মানুষজন নেই। কনের বাড়ীতে বইছে কান্নার মাতম।
কনের বাবা মাসুম বিল্লাহ মনির বলেন, আমার কিছুই বলার নেই। আমি শ্বশুর বাড়ীর মানুষকে কি জবাব দেব? আল্লায় কেন আমার উপরে এতো বড় বিপদ দিল? বরের বাবা কাউনিয়া ইব্রাহিম একাডেমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সেলিম মাহমুদ বলেন, এমন ঘটনার আমি হতভম্ব কনে পক্ষের লোকজনের জন্য সকল আয়োজন ছিল কিন্তু একটি ফোনে সকল কিছু ভেস্তে চলে গেল।
গত ১০ বছর ধরে এ ভাঙ্গা নরবরে ব্রীজের উপর দিয়ে হলদিয়া ইউনিয়ন ও চাওড়াসহ উপজেলার অন্তত অর্ধ লক্ষ মানুষ চলাচল করতো। ব্রীজ নির্মাণকারী ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার শাস্তি দাবীতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ঘটনা ঘটেছে শনিবার দুপুর দেরটার দিকে।
আরও জানাযায়, আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী অধিদপ্তর ২০০৮-০৯ অর্ধ বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলার চাওড়া ও হলদিয়া ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত চাওড়া নদীর উপর হলদিয়া হাট এলাকায় আয়রণ ব্রীজ নির্মাণের দরপত্র আহবান করে। ওই ব্রীজের নির্মাণ কাজ পায় তৎকালিন হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি শহীদুল ইসলাম মৃধা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে ব্রীজ নির্মাণকালে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা ব্রীজ নির্মাণ করেছে। নির্মাণের পাঁচ বছরের মাথায় ব্রীজের মাঝের ভীম ভেঙ্গে যায়। গত ১০ বছর ধরে ওই ভাঙ্গা ব্রীজ দিয়ে হলদিয়া ইউনিয়ন ও চাওড়াসহ উপজেলার অন্তত অর্ধ লক্ষ মানুষ চলাচল করে আসছে।
এদিকে এ ঘটনার পরপর ব্রীজ নির্মাণকারী ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার বিচার দাবীতে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছে। খবর পেয়ে বরগুনা-১ আসনের সাংসদ গোলাম সরোয়ার টুকু, জেলা প্রশাসক মোহাঃ রফিকুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব গোলাম সরোয়ার ফোরকান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) তারেক হাসান, সহকারী পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, ওসি কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছেন।
মাইক্রোবাসে থাকা সোহেল মিয়া বলেন, মাইক্রোবাসে কনে পক্ষের ১৬ জন যাত্রী বরের বাড়ীতে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে হলদিয়া হাট ব্রীজের উঠামাত্রই ব্রীজ মাঝখান দিয়ে ভেঙ্গে মাইক্রোবাসটি নদীতে পড়ে যায়। আমিসহ ৩ জন সাতরে কিনারে উঠতে পেরেছি। পরে স্থানীয়রা, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম স্বপন ও নাশির উদ্দিন বলেন, মাইক্রোবাস ও অটোগাড়ীটি ব্রীজের মাঝখানের আসা মাত্রই ধপাস করে ব্রীজ ভেঙ্গে নদীতে পড়ে যায়। তাৎক্ষনিক আমরা স্থানীয়দের নিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চালাই। পরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়।
একই পরিবারের তিন নিহতের স্বজন আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার কিছুই রইলো না। আমার দুই কন্যা ও স্ত্রী মারা গেছে। সব হারিয়ে আমি এখন অসহায়।
হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ আসাদুজ্জামান মিন্টু মল্লিক বলেন, ব্রীজ নির্মাণ কালে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা ব্রীজ নির্মাণ করেছে। ফলে নির্মাণের অল্প দিনের মধ্যেই ব্রীজের মাখঝানের ভীম ভেঙ্গে গেছে। ওই ভাঙ্গা ব্রীজ দিয়ে অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ চলাচল করতো। তিনি আরো বলেন, এই ভাঙ্গা ব্রীজ মেরামতের জন্য আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বহুবার জানিয়েছি কিন্তু তিনি আমলে নেয়নি। যার ফলে আজ ৯ জনের প্রাণ গেল। ঠিকাদার দায়সারা ব্রীজ নির্মাণ করায় এবং উপজেলা প্রকৌশলী ব্রীজ সংস্কার না করায় তাদের শাস্তি দাবী করছি।
আমতলী থানার ওসি কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু বলেন, ব্রীজ ভেঙ্গে মাইক্রোবাস নদীতে ডুবে নিয়ে বিয়ের কনে পক্ষের ৯ জন মানুষ মারা গেছে। নিহতদের ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা বলেন, আমি যথাযথ ভাবেই ব্রীজ নির্মাণ করেছি। ব্রীজ নির্মাণ কাজে কোন অনিয়ম করিনি।
আমতলী ফায়ার সার্ভিসের ওয়ার ইনচার্জ মোঃ হানিফ বলেন, চার ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে মাইক্রোবাস উদ্ধার করতে পারিনি। উদ্ধার চেষ্টা অব্যহত আছে।
আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, ব্রীজ ভেঙ্গে নিহত ৯ জনই হাসপাতালে আনার পুর্বেই মারা গেছেন।
আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমতলীতে আমার যোগদানের পুর্বে এ ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কিছুই জানা নাই।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) তারেক হাসান বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছি। উদ্ধার কাজের তদারকি করছি।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছি। এ ব্রীজ নির্মাণ যে ঠিকাদার অনিয়ম করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বরগুনা-১ আসনের সাংসদ গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, নিহতের স্বজনদের হাসপাতালে সমবেদনা জানিয়েছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছি। ঘটনাস্থলে বিক্ষুদ্ধ মানুষকে শান্ত করেছি। তিনি আরো বলেন, ব্রীজ নির্মাণে অনিয়মের কারনে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিহতের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হবে।
#
মোঃ মিজানুর রহমান মিজান
আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি
০১৭১০৯৮৩২৫১