দেশের চিনি পরিশোধন কারখানাগুলোয় অপরিশোধিত চিনির ঘাটতি নেই। আগামী তিন মাস চলার মতো চিনির মজুত আছে। সরকারের তরফ থেকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে পরিশোধিত চিনি পেতে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হবে না। এতে বাজারে চিনির সংকট কেটে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছে চিনি কারখানাগুলোর মালিকপক্ষ।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন চিনি পরিশোধন কারখানাগুলোর ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। এ জন্য সরকারকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি গ্যাসের চাপ নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখার আহ্বান জানান তারা।
এ সময় চিনি কারখানার প্রতিনিধিরা বলেন, সামগ্রিকভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। জাহাজের পরিবহন ব্যয় ও ডালার বাবদও অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। এতে পণ্যের মূল্য একেক সময় একেক রকম হচ্ছে। এ জন্য সরকারের প্রতি ১৫ দিন পর দাম সমন্বয়ের বিষয়ে ভাবতে হবে। এ ছাড়া চিনির শুল্ককাঠামো সংস্কারের প্রস্তাবও দেন তারা।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, ‘চিনি নেই, এমনটা বলা যাবে না, অপরিশোধিত চিনি আছে। আমরা পরিশোধনের পর প্রয়োজনমতো চিনি সরবরাহের চেষ্টাও করে যাচ্ছি। তবে গ্যাস সংকটের কারণে চিনির কয়েকটি কারখানা পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এ জন্য বাজারে প্রভাব পড়েছে।’ তবে পরস্পরকে দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বাজারের এ সংকটের দায় সবারই নেয়া উচিত। কোনো এক পক্ষের ওপর বিষয়টি না চাপিয়ে একসঙ্গে কাজ করলে দ্রুত সংকটের সমাধান হবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ও পরিবেশকদের অভিযোগ, মিল থেকে চিনি সরবরাহ কমানো হয়েছে। বারবার চিনি চেয়েও তারা পাচ্ছেন না। মিল ফটকে গাড়ি বসে থাকায় ভাড়ার টাকা গুনতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। চিনি কেনার ক্ষেত্রে মিলগুলো পাকা রসিদ দিতে অনীহা দেখাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে রসিদে পণ্যমূল্য না লিখে বাড়তি দামে বিক্রি করছে, এমন অভিযোগও তোলেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
কারওয়ান বাজারের চিনি পরিবেশক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘‘আমি চিনি কেনার জন্য সিটি, মেঘনা ও দেশবন্ধু গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, কিন্তু কেউ আমাকে চিনি দিচ্ছে না। বাইরে থেকে দু-একজন চিনি দিলেও সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। এদিকে পাউরুটি, বিস্কুট বা কেক তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের বলছে, ‘চিনি দিন, না হলে আমাদের কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।’ এখন সে জন্য আমাদের বাড়তি দামে চিনি কিনে হলেও তাদের দিতে হচ্ছে। এতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছের।’’
তবে এসব অভিযোগ নাকচ করে গোলাম রহমান বলেন, ‘যার যত চিনি লাগে, আমাদের জানানো হলে আমরা দেব। চিনির দাম বাড়তি রাখাও হচ্ছে না। তবে অনেকে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছেন। এ জন্য সরকারকে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি চিনির বিদ্যমান শুল্ককাঠামো সংস্কার ও ডলারের স্থিতিশীল দরে ঋণপত্র খোলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘আমাকেও যে এক কেজি চিনি কিনতে হচ্ছে, তাতে ৩০ টাকার ওপরে শুল্ক দিতে হচ্ছে। যেহেতু বিশ্ববাজারে এখন পণ্যমূল্য বেশি, সেহেতু সরকারের কাছে আমরা শুল্ক হ্রাসের আবেদন জানাচ্ছি।’
অনুষ্ঠানে চিনি কারখানার প্রতিনিধিদের উদ্দেশে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, ‘সরকার শুল্ক হ্রাস করলে দাম কমে আসবে, এমন কথা দিতে পারলে অবশ্যই সরকার সেটি বিবেচনা করবে। আমরা সরকারকে সেটা বলব। তার আগে আপনারা যেহেতু বলছেন, চিনির তেমন কোনো সংকট নেই, সেহেতু বাজারে সরবরাহ বাড়ান। আমরা আশা করব, আজ রাত থেকে মিলের ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকগুলো ভরে বাজারে চিনি পাঠানো শুরু করবেন।’
গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলছেন উল্লেখ করে শফিকুজ্জামান আরও বলেন, ‘আমরা পেট্রোবাংলার সঙ্গে কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। তাতে সবাই বিষয়টি অবহিত যে আপনারা গ্যাস কম পাচ্ছেন। গ্যাসের চাপও কম। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে ঠিক, কিন্তু সবকিছুর আগে আমাদের ভাবতে হবে যে ভোক্তার কষ্ট হচ্ছে। সে জন্য পরিস্থিতি কীভাবে দ্রুত স্বাভাবিক করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। আশা করি, দ্রুতই চিনির বাজারে অস্থিরতা কমে যাবে।’
চিনির মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘আমাদের পরিদর্শনে দেখেছি, মিল থেকে চিনির সরবরাহ কমেছে। অনেক ক্ষেত্রে তা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে। আবার নরসিংদীর একটি কারখানায় কিছু অনিয়মও পেয়েছি আমরা। তাদের বলার পর সংশোধন করা হয়েছে। বাজারে এভাবে কোথাও কোনো একটি সমস্যা থেকে পুরো প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব পড়ছে। এগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করার কাজ চলছে।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ছোট ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কারণ, ভোক্তা অধিদপ্তর ছোট ব্যবসায়ীদের দোকানে পায়, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসে। কিন্তু এখানে ওপর থেকে সবাইকে নজরদারিতে নিয়ে আসা দরকার। কারণ, বেশি দামে পণ্য কিনতে হলে খুচরা ব্যবসায়ীকেও বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হয়। তা না হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন।’