সড়কে গণপরিবহণের ভাড়া নৈরাজ্য কোনোভাবেই থামাতে পারছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বাড়তি ভাড়া আদায়ে নানা ধরনের কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছেন পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা।
এর মধ্যে একটি কৌশল হচ্ছে, বাস চলছে সিএনজিতে কিন্তু সামনে লাগানো হয়েছে ডিজেলচালিত স্টিকার। কিছু ক্ষেত্রে নতুন ভাড়ার চার্টও লাগানো হয়েছে। এসবের মাধ্যমে সিএনজিচালিত বাসটিকে ডিজেলে চলছে বলে প্রমাণের চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনেক বাসে গোপন রাখা হয় সিএনজির সিলিন্ডার ও গ্যাস ঢুকানোর নোজ্যাল। এভাবে যাত্রীদের ঠকাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন কিছু অসাধু পরিবহণ নেতা। বাড়তি ভাড়ার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলেই ওই এলাকায় চলাচলরত বাসের শ্রমিকদের আগাম তথ্য জানিয়ে গাড়ি বন্ধ রাখার গোপন নির্দেশনাও দেন তারা। ফলে বাসের অভাবে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়ছেন।
গত রাতে সরেজমিন এ ধরনের বেশ কয়েকটি বাসের সন্ধান মিলেছে। এর একটি হচ্ছে সেফটি পরিবহণের বাস। বাসটির এ কৌশল ধরা পড়েছে। এর রয়েছে তেল রিফিল করার ফিলিং পয়েন্টও। তবে পয়েন্টটি খুললেই দেখা যায় এটা আসলে সিএনজি নেওয়ার নোজ্যাল। এমনকি বাসটি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে গ্যাসের মিটারও। শুধু তাই নয়, মূল জায়গা থেকে গ্যাসের সিলিন্ডার সরিয়ে অন্য জায়গায় বসানো হয়েছে। একইচিত্র দেখা গেছে, মিরপুরে পার্কিংয়ে রাখা ৯টি গাড়িতে। এ নয়টি গাড়ির মধ্যে ৪টির নিচে দেখা যায় গ্যাস সিলিন্ডার। একটি গাড়ির লোক স্বীকার করেন তারা সিএনজিতে চলাচল করে। মালিকের দাবি, এখনও আগের ভাড়া নিচ্ছে তার সুপারভাইজার। কিন্তু পরদিন ওই বাসটিকে ডিজেলচালিত দাবি করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। একই চিত্র দেখা গেছে তেঁতুলিয়া কোম্পানির কয়েকটি বাসেও। ওইসব বাস সিএনজিতে চললেও ডিজেলচালিত বলে বেশি ভাড়া নেওয়া হয়। গাবতলী রুটে চলা ৮ নম্বর বাসের যাত্রী মো. মোশাররফ বলেন, ৮ নম্বর রুটের বেশিরভাগ বাসে গ্যাসের সিলিন্ডার রয়েছে। যাত্রীরা জিজ্ঞেস করলে বলছে, তেলে চলি। আগে সিএনজিতে চলত। তাই সিলিন্ডার রয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তেল আর গ্যাসের গাড়ি চেনা যাচ্ছে না আলাদা করে। বেশিরভাগ বাসের কোনটি সিএনজিতে আর কোনটি গ্যাসে চলে তা চেনার উপায় নেই। এভাবে লুকোচুরি করে সিএনজিচালিত বাসেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ পেয়েছে বিআরটিএর বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৮ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৮১টি সিএনজিচালিত বাসের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর মধ্যে ৭০টি বাসের বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবারও বিভিন্ন অপরাধে ৩৪২টি বাস-মিনিবাসকে জরিমানা করা হয়। যার মধ্যে ৬১টি সিএনজিচালিত বাস রয়েছে। অপরদিকে ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির নেতারা শুধু রাজধানীতে ২৪০ থেকে ২৪৫টি বাস চিহ্নিত করেছে যেগুলো সিএনজিতে চলে। এসব বাসের বেশিরভাগই বাড়তি ভাড়াও আদায় করে।
সিএনজিচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. সরওয়ার আলম যুগান্তরকে বলেন, অনেক বাসেই এটা করছে। আমরা সব বাস মালিকদের বলেছি, কোনটি সিএনজিতে চলে আর কোনটি ডিজেলে চলে তা লেখা স্টিকার যেন বাসে লাগিয়ে দেন। আমাদের কর্মকর্তারাও বাসে এ স্টিকার লাগিয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরাও মনিটরিং করছেন। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে জরিমানা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়বার করলেই জরিমানার হারও বাড়ছে। সামনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে কারাদণ্ড দেওয়ার চিন্তা আছে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ৭ নভেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ায় সরকার। তবে সিএনজিচালিত বাসে নতুন এ ভাড়া কার্যকর হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সময়ে বলা হয়, ঢাকা এক থেকে দুই শতাংশ সিএনজিচালিত বাস রয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, সিএনজিচালিত বাসের সংখ্যা অনেক বেশি। ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় ৬ হাজার বাস চলাচল করে। এর মধ্যে ২৪০-২৪৫টি বাস চিহ্নিত করেছেন মালিকেরা। ওইসব বাস সিএনজিচালিত। তারা ডিজেলচালিত বাসের সমান ভাড়াও আদায় করছে। তবে সম্প্রতি কয়েকটি বাসে সিএনজিচালিত স্টিকার লাগানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির নির্বাহী সভাপতি আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, কিছু গাড়ি প্রতারণা করে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে সত্য। তবে সেই সংখ্যা বেশি নয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি বাস কোম্পানির ২০০ বাস রয়েছে। এর মধ্যে ৫-১০টি বাস সিএনজিচালিত। তাদের কেউ কেউ বেশি ভাড়া নিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রশাসন শক্ত না হলে সিএনজিচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়া বন্ধ করা সম্ভব নয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মালিকেরাও কঠোর অবস্থানে আছেন। যারা এভাবে প্রতারণা করবে তাদের রুট পারিমট বাতিলের সুপারিশ করা হবে।