মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি
বাংলাদেশ সম্প্রীতি ও সৌহাদ্যপূর্ণ একটি দেশ। সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান এখানে নেই। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে এই শব্দটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আমাদের দেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতেই মুষ্টিমেয় উগ্রবাদী মনমাসিকতার দোসররা সদা ব্যস্ত থাকে। ষড়যন্ত্রকারী সব সময় ওঁত পেতে থাকে। থাকে তৎপর। কিন্তু যাদের নিয়ে এসব কাহিনী। তাদেরকে উসকানি দিয়েই মূলতঃ দুই দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় অরাজকতা ও দাঙ্গা ফ্যাসাদ ঘটানোই চক্রান্তকারীদের আসল উদ্দেশ্য। এতে দুই দেশের হিন্দু মুসলমান দুই জাতিই বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা আমরা স্বচোখে দেখছি কিন্তু বুঝতে পারছি না। টের পাচ্ছি না। এবার যদিও বিষয়টা স্পষ্টকারে ধরা দিয়েছে। কলুষতার সাথে সম্পৃক্ত সব প্রচেষ্টা আমরা সফলতার সাথে মোকাবিলা করে আসছি। এবারও ব্যর্থ করতে পেরেছি। এটাই আমাদের সাফল্য। ভারতীয় মিথ্যে ফেক ষড়যন্ত্রের কোন ঠাঁই নেই এদেশে আর হবে না। সাম্প্রদায়িকতার কোন সুযোগ নেই এখানে। প্রতিটি নাগরিক আমরা সতর্ক। প্রতিটি ধর্মীয় সংগঠনকেও বাইরের দেশের সব অনাকাঙ্খিত উসকানি থেকে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা এদেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করছি। যে কোন চক্রান্তের মোকাবিলাও আমরা সবাই একসাথেই রুখে দিবো।
আমরা দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। একসময়ের দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সু-সম্পর্ক এখন তিক্ততায় ঠাসা! অযথা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে ভারতের ফায়দা তো কিছুই হলো না, উল্টো দুটি দেশের জনগণের ভেতর মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। পুরো সোস্যাল মিডিয়া-ই ভারতের আরও একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টায় এখন হাসাহাসিতে ব্যস্ত আছে। বিশ্ব তোলপাড় করতে চেয়ে ভারত নিজেরাই এখন হাসির পাত্র! তবে এসব ঘটনা শুধু অনাকাঙ্খিতই নয়, দুই দেশের আত্মিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ উদ্বেগের বিষয়। কোন দেশে যদি দেশের স্বার্থ বিরোধী কেউ কোন কাজ করে থাকে। তাকে সেই দেশের সরকার কি গ্রেফতার করবে না? ভারত কোন দায় থেকে আসল বাংলাদেশের সাথে পায়ে পড়ে ঝগড়া করতে? শুধু গলাবাজিতেই শেষ নয়। ভারত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় নিয়ে ক্রুদ্ধ অভিযোগ এনেছে। যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট। ভারত নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের বিশেষ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেই না। বরং অন্য দেশ নিয়ে মিথ্যে কল্পকাহিনী শুরু করে দিয়েছে! সম্পুর্ণ-ই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে। রীতিমত নৈতিকতা বর্জিত মৌণ যুদ্ধের সামিল। ভারতের মিথ্যে প্রপাগান্ডা অত্যন্ত সুকৌশলে মোকাবিলা করেছে আমাদের পররাষ্ট্র দফতর। আমাদের ছাত্র-জনতা। আপামর দেশের মানুষ। যা আমাদের জাতীয় চেতনা বিকাশে আরও একটি সাফল্যময় অধ্যায় বলা চলে।
ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপী সরকার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত হামলার মিথ্যে অভিযোগ তুলল। ভারতের গণমাধ্যম মিথ্যে অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করল। ফলাফল কি ঘটল? আমরা তো শান্তিপ্রিয় দেশ। এদেশের মুসলিমরা কি ওদের মতো উগ্রতার পরিচয় দিয়েছে? ওরা হিন্দুত্ববাদীরা একের পর এক জঘন্য কান্ড ঘটালো। বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা থেকে শুরু করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপত্তলিকা দাহের মতো ঘটিয়েছে। মসজিদ ভাংচুর করেছে। আমাদের কনস্যুলার অফিসে আক্রমণ করেছে। আরও কত কী! দুই দেশের তোলপাড়ে কাঠগড়ায় এখন ভারতের গণমাধ্যম। আর তাদের প্রপাগান্ডা। মিথ্যে ভুয়া তথ্য পরিবেশনা। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বিজেপীর শাসনামলের ভুড়ি ভুড়ি সংখ্যালঘু নির্যাতন চোখে দেখছে না। বারবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানালেও ভারত সরকার নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে কি করে দেখাতে পেরেছে? নেপালের জনসংখ্যার প্রায় ৮১ শতাংশ হিন্দু শ্রেণী। এখন প্রশ্ন করতে হয়-আমরা বাংলাদেশীরা কি নেপালকেও ঘৃণা করব? ওদের পতাকায় আগুন দেবো? এদেশে যদি হিন্দুদের আমরা শত্রু মনে করি, তাদের সংখ্যালঘু বানিয়ে শুধু অত্যাচার করি, তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল, কি বোঝাতে চাইল ভারতীয় গণমাধ্যম? সেই হিসেবে নেপাল দেশটাই তো পৃথিবীতে একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র, তো সেই রাষ্ট্রকে কেন ভারত নিজেদের শত্রু মনে করে? বিগত ১৫ টি বছর বিগত স্বৈরাচার সরকার ভারতকে এদেশে নিয়ে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে বলেই, ভারত মনে করছে-বাংলাদেশ সব সময় তাদের নতজানু থাকবে? দক্ষিণ এশিয়ার আর একটা দেশও কি ভারতের কাছে নিজেদের এভাবে সপে দেয়ার নজির রেখেছে? প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে যখন বিদায় করা হলো, তখন দোসরা কোথায় ছিল? বিশ্বজিৎ -এর মত একটি তড়তাজা ছেলেকে যখন কুপিয়ে হত্যা করল আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা, তখন ওপার থেকে তো দাদাবাবুরা নিরপরাধ এই হিন্দু ভাইটির জন্য একটুও গলাবাজি করল না? সুতরাং ভারতীয় অপপ্রচার সব ভুয়া। কোনদিনও সফলতার মুখ দেখবে না। তাদের বুঝতে হবে- উসকানির একটা লিমিট থাকা প্রয়োজন। ভারতীয় মিডিয়া এবারের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হলে, সারা বিশ্বে ভারত বিশ্বাস যোগ্যতা হারাবে। ওদের অবস্থা হবে বাঘ ও রাখালের গল্পের অনুরূপ।
এদেশের গণমাধ্যম যারা ভারতীয় স্ক্রীপ্টের রূপান্তরের কাজে নেমেছে, এমন বিশ্বাসঘাতকদের জাতি কখনও ক্ষমা করবে না। দোসরদের মনে রাখতে হবে। আমরা বাংলাদেশীরা যেমন স্মার্ট। তেমনি সাহসী। নাটের গুরুদের চিহ্নিত করে জাতির সামনে নিয়ে আসতে মেধাবীদের বেশিদিন সময়ও লাগবে না। এটা কারও বুঝতে বাকি নেই। ভারত সরকার কি চাইছে। এতদিন ধরে মেহমানদারী করে কি তারা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে পুনরায় মসনদে বসিয়ে দেবে। এসব অবান্তর খায়েস। পনেরটি বছর স্বার্থ হাসিল করে স্বার্থে ব্যঘাত ঘটায় তাদের সর্বশেষ ইস্যুটি ছিল ইসকন। আর সন্নাসী চিন্ময়কৃষ্ণ। এই ইসকন সংগঠন নিষিদ্ধ করা নিয়ে কি কান্ড ঘটল। কেন ঘটল। সবই জানে সবাই। এখন এই সংগঠন নিয়ে খতিয়ে দেখার পালা- প্রকৃত অর্থে ইসকনের কতজন সদস্য প্রকৃত বাংলাদেশের নাগরিক। ইসকন যে একটি উগ্রবাদী সংগঠন, চট্টগ্রামের আইনজীবি সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার মধ্য দিয়ে সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। নিজ দেশে যাদের শান্তি আজ ডাস্টবিনের বস্তু, তারা শোনায় শান্তির অমোঘ বাণী! তাদের মাথাভর্তি গোবরভরা গণমাধ্যম তো এখন বলছে, পবিত্র আজমীর শরিফেও নাকি একসময় তাদের মন্দির ছিল? কি যে সব অবান্তর গুজব ছড়ানো দেশ ভারত। বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। সেই কারণেই তো মাইক্রোসফটের এক জরিপে বলা হয়েছে- “বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া সংবাদ পরিবেশন করে ভারত। সবচেয়ে মিথ্যে বানোয়াট আর গুজব ছড়াতে পটু দেশ হচ্ছে ভারত।” আমাদের দেশের হিন্দু ভাই বোনরা কি এতই বোকা? পঁচা শামুকে কেন গিয়ে পা কাটবে। বাংলার হিন্দু সমাজ জানে, মানবতার বুলি আওড়ানো আর ধর্মকে ভুলুণ্ঠিত করার দেশ বাংলাদেশ নয়। এসব কাজে ভারত কতটা মারাত্মক ও উগ্র একটি জাতি সত্তার দেশ। বাংলাদেশ মন্দির ভেঙে কোনদিন মসজিদ নির্মাণ করেছে? তারা তো মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন বাবরী মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির করেছে? পুরো পৃথিবী দেখেছে। বাংলাদেশে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা ঘটেছে পুজামন্ডপে। আগুন, ভাংচুর, এগুলো তো ছিল সব চক্রান্ত। ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ। ভারতের লেজ চাটা এক শ্রেণীর দোসর এসব চক্রান্ত করে সবসময় বিশ্বাবাসীকে দেখাতে চেষ্টা করেই যাবে- বাংলাদেশে হিন্দুরা ভাল নেই। বাড়াবাড়ি পন্ডিতি করতে গিয়ে ভারত এবার স্বৈরাচারের পক্ষে নিজেদের অবস্থান আরও স্পষ্ট করলো। ভারত নাকি প্রচন্ড রকমের ধর্মভীরু দেশ। অথচ প্রতিহিংসা পরায়নে তাদের তুলনা বিরল! ভারত কতদিন ভিসা বন্ধ রাখবে। কতদিন বাংলাদেশের মানুষকে চিকিৎসা সেবা ও অপারেশন না করার হুমকী দিবে। চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশীদের ভারতের নেতারা আমাদের পাকিস্তান যেতে বলছে। তাদের হোটেল, খাবার, জরুরি পরিষেবা সব বন্ধ করে দিচ্ছে। সবই নিচু মনমানসিকতার পরিচায়ক। ভারতীয় পতাকায় প্রণাম না করলে নাকি তারা বাংলাদেশীদের চিকিৎসা নিতে দিবে না! কি যে জঘন্য মানবতার নিদর্শন স্থাপন করল নেতা নামধারী ভারতীয় রাজনৈতিক কিছু ব্যক্তিবর্গ। তা বলার ভাষা নেই। ভারতীয় পন্ডিতেরা কি জানে না, চিকিৎসা কি শুধু ভারত-ই করে থাকে। বিশ্বে আর কোন দেশে কি কম খরচে চিকিৎসাসেবা কি নেই। ভারত প্রতিহিংসামূলক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, আমরা কেন বসে থাকব? আমরাও বিকল্প পথ খুঁজে বের করব। সরকারকে কম খরচে দেশে-বিদেশে আরও উন্নত চিকিৎসাসেবার বিষয়টি জরুরিভাবে ভেবে দেখতে হবে। তারা অপপ্রচার চালাবে। তারাই করবে গলাবাজি। আর বড় বড় নেতারা দিবে উসকানিমূলক বক্তব্য। এতে দুই দেশের উত্তেজনাই শুধু বাড়বে। কমবে না। ফলে কি ঘটবে? ঔখানে ওরা মসজিদ ভাঙবে। এইখানে ওদেরই দোসরা মন্দিরে দিবে আগুন। মাঝখানে সব দায়ভার তুলে দেয়া হবে নিরিহ ধর্মভীরু শ্রেণীর ওপর। বলা হবে মুসলমানরা জঙ্গী! অথচ দিন দুপরে মানুষ মেরে ফেলা ‘ইসকনে’র মতো একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের অভিযুক্তকে বাঁচাতে কাটাতারের ওপার থেকে ভারত এখন কি না করছে? ছাত্রলীগ শত শত হত্যার সাথে জড়িত হলো। এই সংগঠনকে কি নিষিদ্ধ করা হয়নি? ইসকন এই দোষে দুষ্ট হলে তাদের কার্যক্রমও এই দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে। এটাই স্বাভাবিক। দেশের ভালর জন্য সরকার যা খুশি করবে। এই দেশের নিজস্ব বিষয়ে, আইনের প্রয়োগের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয়দের কোন এখতিয়ার নেই কথা বলার। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও নেই। একজন হত্যাকান্ডে অভিযুক্তের মুক্তির বিষয়ে উসকানির কোন সুযোগ নেই। তা না করে বরং নিজেদের মানসিক মানবিক উৎকর্ষতা গঠনে নজর দেয়াটা জরুরি। যেই আসামীর পক্ষে নেই কোন আইনজীবি। জামিন যায় পিছিয়ে। তার জন্য উদ্বেলিত হয়ে গণমাধ্যমে যা খুশি তাই প্রচার করল। মোদি সরকার এর কৈফিয়ত পর্যন্ত জানতে চাইলো না। শেখ হাসিনার মতো শত খুনের আসামী স্বৈরাচার অতিথির কল্যাণে ভারত যত প্রকার অবান্তর মিশন হাতে নিয়েছে। সব পরিকল্পনাই যে জলাঞ্জলি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অপপ্রচার রোধে আমরা জাতি আজ একতাবদ্ধ।
এখনও সময় আছে ভারতকে প্রতিবেশী দেশের সাথে সু-সম্পর্ক নিয়ে কাজ করার। একজন বিশেষ মানুষের চেয়ে কোটি কোটি বাঙালীর স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করা। নয়াদিল্লি সু-সম্পর্ক নিয়ে অন্তবর্তী সরকারের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক ঠিক আছে। কিন্তু নয়াদিল্লিকে প্রথমেই বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা বন্ধ করতে হবে। তবেই ঘুঁচবে সব আঁধার। কেটে যাবে মেঘ। এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায় প্রশমিত হবে উত্তেজনার কালো পাহাড়।
লেখক: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা