২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / ভোর ৫:৪৪
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / ভোর ৫:৪৪

বিশ্বকাপ রম্য:

ভালোবাসার বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপে মাতোয়ারা সারা বিশ্ব। পৃথিবী এখন একপ্রকার গরম হয়েই আছে। গতকাল বিটিএস এর ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের থীম সংয়ের মাধ্যমেই যেন এই উত্তাপ আরও বেড়ে এখন চরম। আর আমাদের ওয়ার্ল্ডকাপ ফ্যানদের কথা তো আর বলারই অপেক্ষা রাখে না। জুয়ান বুড়ো নাতী নাতনিদের কথা বলার চেয়ে আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি যে যার ঘর বাড়িতে। পথে প্রান্তরে। দোকানে দোকানে। পতাকা আর প্রিয় দেশের জার্সি কেনার যে হিরিক। যে কোন স্পোর্টস্ শপগুলোতে তাকালেই ভিমরি খেতে হবে। এত ভীড়। যেন দেশে পুজোর কিংবা ঈদ শপিং চলছে !

পাগলের মত সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে বিরাট এক হোঁচট খেয়েছি। বলবেন, কেন? আর বলবেন না ভায়া, অফিস করে বাড়ি চলে এসেছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম আমার পিচ্চিটার জন্য আর্জেন্টিনার জার্সি কিনতে। দম ফেলতে পারলাম কই। দরজায় মাথা ঢুকাতেই আমার বাবু বলে, আব্বু মেসির গেঞ্জি কই… গিন্নির দিকে তাকিয়ে বললাম এই যা, সর্বনাশ ! ভুলেই তো গেছিরে বাপ! এমন কান্না জুড়ে দিলো- সারা বিল্ডিংয়ের মানুষ ছুটে এলো। কি হয়েছে ভাই সাহেব ? যে লোকটা জানতে এসেছে কি ঘটনা, ঘটনাতো আরও উসকে দিলো এই মানুষটাই। যে কিনা নিজেই দামড়া ফিগার নিয়ে আর্জেন্টিনার জার্সিটা গায়ে দিয়ে এসেছে ! বডির কন্ডিশনে পুরো আর্জেন্টিনা দেশটাই যেনো ফেটে যাচ্ছে ! বাবুকে নর্মাল করতে আমিও নর্মাল সুরেই বললাম, বাবুরে, তোর আশিক আঙ্কেলের মত একটা গোলকিপার যদি আর্জেন্টিনা দলে ফিট করা যেত নেইমারের বাবাও গোল করতে পারত না, হে হে হে …

এমন বডির লোকটা একটু লজ্জা পেলো। কাশিও দিলেন। স্ত্রী দিলেন বকা। এই কি সব বলছো। ভাইয়া আপনি কিছু মনে করবেন না। ব্রাজিল করে কিনা ? ইতিমধ্যেই ফ্ল্যাটের আরও কয়েক ওয়ার্ল্ডকাপ পিচ্চিফ্যান আমার হাত পা টেনে ধরল, আর বাবু তো কোলেই উঠে আছে- এক্ষুনি আমাকে মেসির জার্সিটা কিনে দিতে হবে ? ওর মা বলল, খুব ভালো হয়েছে। যা তোরাও সাথে যা! এবার হলো ? আন্ডা বাচ্চা সব নিয়ে ছুটলাম। ওহ্, আসার সময় উনিও বলে দিলেন, শোনো- আরও দুইটা জার্সি বেশি কিনো। তোমার যে দুই শালিকা আছে সেটা আবার ভুলে যেও না যেন, একজন ব্রাজিল আর একজন আর্জেন্টিনা। বললাম, শশুর শাশুড়ির লাগবে না ? এ কথা শুনে স্ত্রীর যেই দাবড়ানিটা খেয়েছি। সেই হয়রানি থেকেও বেশি হয়রানি হচ্ছি এখন পিচ্চিদের পতাকা, জার্সি আর নানান বাহারি আবদারে ! কি যে অবস্থা বলার ভাষা নাই। পতাকাআলা মনে হয় দেশে একটাও বাড়িতে নেই ? বাঁশের ডান্ডায় পতাকা বেধে সব যেন শহরে নেমে এসেছে। আর আন্ডা বাচ্চা দেখেছে না। ওদের দেখে তো এক বুড়ো পতাকা ব্যবসায়ী গানই জুড়ে দিয়েছে-এই বিশ্বকাপের পতাকায় বিশ্ব- দেখো, বাতাসে উড়ে …বাবুর যেন মনে ধরেছে লোকটার গান। ওকে টেনে ধরি। বাপ আয় তো। পতাকা তোকে দিতে গেলে এখন পাইকারি দিতে হবে। কতগুলো সাথে নিয়ে এসেছিস? ছেলে তো গতকালের কাতার ইকুয়েডরের রেফারির মত হুইসেল বাজানো শুরু করে দিচ্ছিলো প্রায়… জলদি মুখ চেপে ধরি, কোনো কান্নাকাটি হবে না। আয় তো আগে তোদের জার্সি কিনে নেই। পতাকা কিনে শেষে দেখা যাবে জার্সির টাকা নাই। পড়ে কি পতাকা গায়ে পেচিয়ে খেলা দেখবি ? ওদের মধ্যে একটা বিচ্ছুও ছিলো। শাওন নাম। বলল, আঙ্কেল তো ঠিকই বলেছে। এই বাবু, রাতে স্কুলের পেছনের মাঠে জানিস প্রজেক্টরে খেলা ছাড়বে আকতার-ফারুক আঙ্কেলরা। জার্সি গায়ে দিয়ে আসবি তো? জার্সি কেনার খবর নেই। ফ্যান একটা আরেকটাকে দাওয়াত দিয়ে সারা ! দোকানে নিয়ে গেলাম একেকটাকে টেনে টুনে। ভীড় সাংঘাতিক। এক ছেলের গায়ে টাচ লেগেছে। আমার ছেলে বাবু মনে করে ঔটাকে চেপে ধরেছিলাম। দেখি বেয়াদবের মত ছেলেটা কোক করে উঠল। কি যে হচ্ছে ছেলেগুলোর। বুঝলাম না। এই যুগের ছোকরাগুলোর ধৈর্য বলতে কিছুই দেখছি না। দোকানদার বললেন, না চাচা, আসলে ওর প্রিয় দেশের জার্সি পায় নাই তো তাই মাথা গরম। আপনার কি লাগবে এদিকে আসেন। বুঝলাম না। এ আবার কোন দেশের ফ্যান। বলল, চাচা ওর দরকার জাপানের জার্সি …সর্বনাশ, এই বাবু, তোদের সব আর্জেন্টিনাই তো ? সারা দোকান গরম হয়ে গেলো- আমার বাবুরই শুধু আর্জেন্টিনা। আর একটার শুধু ব্রাজিল। ৩ পিচ্চির একটা স্পেন, একটা জার্মানি, আরেকটা ফ্রান্স। দোকানদারের খুশি দেখে ঠিকই বুঝে নিলাম। সবই আছে মে বী …

আর আন্ডাবাচ্চাদের সাথে আনায় যে গলা কাটবে সেটাও একশভাগ গ্যারান্টি। ঠিক তাই। আমি জানতে চাওয়ার আগেই ক্যাশের যুবক হাক ছাড়ল, ফ্যান জার্সি ৫শ। প্লেয়ার জার্সি ১ হাজার! দোকানে না আসলে জানতেই পারতাম না। ওয়ার্ল্ডকাপের জার্সির গলাকাটা রেটেরও আবার ভেরিয়েশন আছে ! তিন চার জন টানাটানি করল। পিচ্চিগুলোর একটা তো ফ্রান্সের মোরগআলা লোগো লাগানো জার্সি গায়ে দিয়েই বসে আছে। জলদি টেনে খুললাম। বললাম, আঙ্কেল, এগুলো ভাল না। গায়ে দিতে গেলেই ছিঁড়ে যাবে। আসো বাইরে থেকে তোমাদের আরও ভাল জার্সি কিনে দিচ্ছি … দোকানি ছেলেটাও কম সিয়ান না। সে বলল, এই দেখো এই পর্তুগালের জার্সি কিভাবে টানছি। সে টেনে টুনে দেখালো জার্সি ছিড়ছে না। সবগুলোকে জাপটে ধরে কাচের দরজাটা ঠেলে কোন মতে জানও বাঁচালাম। পকেটও বাঁচালাম। সবগুলাকে ফুটে নিয়ে আসলাম। মানে ফুটপাতে। আয় যেইটা নিবেন ৩ শো …ওরা দেখলাম জার্সির চেয়ে গানটাই মজা পাচ্ছে। আমি ঘেটে ঘুটে ক্লান্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় ফুটে তো আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল ছাড়া কিছু পাচ্ছি না। তবে খুব ভালো লাগল। হাইফাই দোকানের চেয়ে ফুটের জার্সির দাম পানির মতই। এতে সাধারণ মানুষগুলোও কম খরচে নিজের সন্তানদের জার্সি কিনে দিয়ে একটু হলেও আনন্দিত হবে। গিন্নি ভিডিও কল দিয়ে বসা। দুই শালির জার্সি কিনেছি কিনা? এদিকে এতগুলো বিচ্ছু হা করে আছে কখন তাদের প্রিয় দলের জার্সি হাতে পাবে? Worldcup Football চারবছর পর শুধু আসেই না। নিয়ে আসে সাথে এক গব্ব যন্ত্রণার বোঝা নিয়ে। আল্লা মালুম। আমাদের বাংলাদেশের সালাউদ্দিন সাহেব যদি কুফরি কালাম করে হলেও কোনোরকমে সেপব্লেটারসাহেবকে কাবু করে এদেশে ওয়ার্ল্ডকাপ নিয়ে আসতে পারতেন, সমগ্রদেশটা থেকেই রং বাহারী জার্সি গুলো উধাও হয়ে যেত আমাদের প্রিয় লাল সবুজের অবগগহনে …কি আর করার। ৪ বছরে একবার বলে কথা। ভালো দোকান থেকেই সবার মুখে হাসি ফোটানো হলো। মার্কেট এরিয়া থেকে বিদায় নেবো। বুড়ো পতাকা আলাইবা কি দোষ করেছে? প্রথমেই সবাইকে আমাদের জাতীয় পতাকা কিনে দিলাম। সাথে একটা করে ফ্লাগ। শর্ত দিলাম- বিদেশী পতাকার সাথে আমাদের পতাকাও রেখো বাবারা। আমরা Worldcup খেলতে না পারি। দেশকে সবার সন্মান দেখাতে হবে। শিশুদের মুখে হাসি ফুটলো।

ফ্ল্যাটে এসেই বাবু বলল, আব্বু বাঁশ তো আনলে না। আর আনব কি রে ব্যাটা , বাঁশ তো খেয়েই যাচ্ছি …দাড়োয়ান দেখি একটা লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে দাঁড়ানো। স্যার এটা চলবে ? ভাই তোমারও কি বাঁশ দেয়া বাকী?

সগীর হাসলো, ছিঃ স্যার কি যে বলেন, দেন দেন সবার ফ্ল্যাগ দেন আমার কাছে …বললাম,

আল্লা তোমাকে নেক হায়াত দান করুন। আমিও যেন বিশ্বকাপের ভাইরাসে মনের আনন্দে ওদের পিছু নিলাম।

সগীর ছাদে যাচ্ছে। পোলাপানের দলও ছুটলো তার পিছু পিছু। এ যেন ওয়ার্ল্ডকাপের এক নয়া হ্যামিলিয়নের বংশীবাদক ! বেচারা রশি দিয়ে বাঁশটা আটকে সবার প্রিয় দেশের পতাকাগুলো শক্ত করে বেধে দিলো। দুরন্ত ‘শান্ত’ অফার করল- সগীর কাকা দেখো আমাদের পতাকাটা সবার উপরে। কি সুন্দর লাগছে। আসো আমরা সবাই আজ কোরাস গাই। সগীর তো বুঝতে পারলো না কি বলল বাচ্চাটা। ও হা করে তাকিয়ে আছে। বাবু বলল, আমাদের সাথে গান গাইতে হবে আঙ্কেল। পিচ্চিরা দাঁড়িয়ে শুরু করল জাতীয় সংগীত:-

আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি …

আমিও নিরবে পেছনে দাঁড়িয়ে না গেয়ে পারলাম না। সবার মাথার ওপরে পতাকায় বাতাসের দোল। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানীর পতাকাগুলো পত পত করছে। কিন্তু আমার প্রাণের বাংলাদেশের পতাকা সবার ওপরে। যেনো- আকাশ ছোঁয়ার প্রত্যাশায়। মনটা বিগলিত হলো। চিৎকার করলাম। প্রাণের দেশ। তুমি বাংলাদেশ।মনের অজান্তেই চোখ মুছলাম। আমরা বিশ্বকাপে খেলছি না বলে না। চোখ মুছলাম। নিজের দেশের অকৃত্রিম ভালোবাসায়। এই ভালোবাসা দেখা যায় না মেসি নেইমারের গোলের মত। এই ভালোবাসা- লাল সবুজ দেশের এই ক্ষুদে ক্ষুদে ভবিষ্যতের কন্ঠে জাতীয় সংগীতের মত। হয়ত একদিন এমন ক্ষুদে ফ্যানরাই আমাদের নিয়ে যাবে।

বিশ্বমঞ্চে……

মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি

Facebook
Twitter
LinkedIn