শিরোনামটি বলার কারণ, যে দুটি ফল খেলে হবে না অনেক রোগবালাই।বাঁচবে ওষুধ কেনার টাকা। হ্যাঁ পাঠক কথাটি পুরোপুরিই সত্যি।সেদিকে দৃষ্টিপাত রেখেই-এই বর্ষায় বৃক্ষালয়’র বৃক্ষরোপন ও বিতরণ-কার্যক্রমেও ফলদুটি প্রাধান্য পাবে। ১৬৪ টি কালোজাম ও ১৫৮ টি সিলেটি পাহাড়ী লেবুর চারা প্রস্তুত ও বিনামূল্যে বিতরণ করবে সংস্থাটি। ‘সবুজ বাঁচাই সবুজে বাঁচি’ পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলনের পথিকৃত ‘বৃক্ষালয়’’একটি ব্যক্তিগত গবেষণা সংস্থা। যারা প্রতিবছরই বৃক্ষরোপনে সহায়তা করছে। সবুজ বৃক্ষেরা চারা উৎপাদন করছে। এবং সর্বোপরি মহতি উদ্যোগটি হচ্ছে যে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে বিনামূল্যে গাছের চারাও বিতরণ করছে। কেননা, একটি সবুজ চারার মাধ্যমেই একটি এলাকায় সবুজ অক্সিজেন ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বৃক্ষরোপনের প্রকৃত স্থান ও বৃক্ষরোপনের নিয়ম কানুনসহ যে কোন পরামর্শ বিষয়ক সহায়তা নিয়ে বৃক্ষালয় সবাইকে গাছ লাগানোর প্রতি সচেতন করছে। যত্রতত্র বৃক্ষরোপন নয়, সঠিক ও প্রয়োজনীয় নিয়মে, প্রয়োজনীয় স্থানে হোক- সবুজায়ন। এই লক্ষ্যে-
পাহাড়ী লেবু ও কালো জাম নিয়ে নিরলস গবেষণা শেষে দেখা যাচ্ছে। শুধু ওষুধ খেয়েই কি যাবো আমরা চিরকাল? এই দুটি ফল খেয়ে যদি নানান রোগব্যধিতে আমাদের বিনা ওষুধে কাজে দেয়। তো আমরা যে যার বাড়িতে বৃক্ষবাগানের লিষ্টে এই অবহেলিত দেশি ফল দুটি কেন রাখব না?
প্রথমে জামের বিষয়ে আসি। যদিও সিজনাল ফল হিসেবে বাজারে এখন জামের শেষ সময় চলছে। চোখে পড়লেই জলদি কিনে ফেলুন। এর বৈজ্ঞানিক নাম Syzygium cumini, (এস.কুমিনি প্রজাতি) যা Mytaceae (মির্টাসিয়া) পরিবারভুক্ত একটি ফল। জামকে আমরা বেশকিছু নামে চিনি। জাম্বুল, জামুন, কালোজাম ইত্যাদি। তবে বাইরের দেশে এর কিছু বিদেশী নাম আছে। যেমন- ড্যানসন প্লাম, ডুহাট, জাভা, জামব্লাং ইত্যাদি। জামের রঙ এত সুন্দর। যে কেউই ফলটি চোখের সামনে পেলে হাতছাড়া করতে চান না। আমাদের দেশের বাজারে প্রধানত তিন ধরনের জাম আমরা পাই। বড়বড় সুমিষ্ট জাম। মাঝারী টক মিষ্টি জাম। আর ছোট আকারের খুব টক জাতীয়, যাকে বলি ভুতি জাম।
এবার আসি জামের পুষ্টিগুণে-
জামে শর্করার পরিমান থাকে ১৫.৫৬ গ্রাম। পটাশিয়াম ৭৯ মিলিগ্রাম। ফসফরাস ১৭ মিলিগ্রাম। ম্যাগনেশিয়াম ১৫ মিলিগ্রাম। ক্যালসিয়াম ১৯ মিলিগ্রাম। সোডিয়াম ১৪ গ্রাম। প্রয়োজনীয় এত পুষ্টির ছড়াছড়ি এই ছোট্ট একটি ফলে। অথচ কত অবহেলায় দেখবেন পড়ে থাকে। যা কোন জাম গাছের নিচে গেলেই আপনি দেখতে পাবেন। মাটিতে পড়ে কিভাবে তার থেতলে যাওয়া জীবন- আপনার দিকে তাকিয়ে আছে?
মার্চ এপ্রিলেই জাম গাছে ফুল আসতে থাকে। মে থেকে ফল ধরা। এরপর ধীরে ধীরে জাম জুন জুলাইতে পাকতে শুরু করে। আপনি হয়ত আগষ্ট মাস পর্যন্ত এই মূল্যবান ফলটি বাজারে পাবেন। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, জামে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, জিংক, কপার, গ্লুকোজ, ডেক্সটোজ, ফ্রুকটোজ, ফাইবার,অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও স্যালিসাইলেটসহ অসংখ্য উপাদান পাওয়া যায়। বাইরের দেশেও জামের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে খুব। একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জাম মানুষকে চিরসবুজ রাখতে সহায়তা করে। মানুষের বয়স যত বাড়বে মানুষ ততই স্মৃতিশক্তি হারাবে। কিন্তু এই ছোট্ট ফলটি মানুষকে প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পুন্ন রাখতে খুব কার্যকর ভুমিকা রাখে। আরেকটি গবেষনায় প্রকাশিত; জাম ডায়াবেটিস নিরাময়েও কাজ করে। দেখা গেছে জাম খাওয়া মানুষের ৬.৫ শতাংশ মানুষের দেহের রক্তের চিনির পরিমান কমাতে সাহায্য করেছে এই কালোজাম। এমনকি জামের বীজে চোখের দৃষ্টিবৃদ্ধি, হার্ট সুস্থ রাখা ছাড়াও জামকে ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদানের কথাও বলেছেন অনেক পুষ্টিবিজ্ঞানী।
আমাদের দেশেও সেই প্রাচীন কাল থেকেই কবিরাজ মহাশয়গণও জামচূর্ণকে একটি অপরিহার্য মহাষৌধরূপে চিহ্নিত করেছেন। জামের বিচচূর্ণও ফেলনা নয়। পাকস্থলী ও লিভারের জন্য বেশ কার্যকর। রক্তচাপ কমানো ছাড়াও ডায়রিয়া, আমাশয়, পাইলস, বমিভাবও দূর করবে এর বিচির পাউডার। অনেকে বলেন, এই চূর্ণ দাঁতের গোড়া ও মাড়িরও শক্তি বৃদ্ধি করে থাকে। মেয়েদের জন্যও জামের বিচচূর্ণ খুব উপকারী, ত্বকের যত্নে ও ব্রণ নিরাময় ছাড়াও প্রসাবের ইনফেকশন (জ্বালাপোড়া), তলপেটে ব্যথা, অনিয়মিত মাসিক সমস্যাতেও অনেক বৈদ্য এই ফল ও বীজচুর্ণ খেতে পরামর্শ দেন। জামের পর এবার লেবুর পালা…
লেবু তো দেশের বাজারের এখন সবচেয়ে সস্তা ভিটামিন সি যুক্ত টকফল। অথচ করোনাকালীন সময়ে একটি লেবু পাওয়া ছিলো যেনো ভাগ্যের বিষয়? লেবুর বিশেষ উপকারের জন্যই জামের পর ‘বৃক্ষালয়’ সবার বাড়িতে লেবুকে পৌঁছে দিতে রোপন করেছে সিলেটি পাহাড়ী লেবু। তবে যে কোন লেবুই উপকারী। যেকোন লেবুগাছই হোক, আপনি বাড়িতে একটি কার্যকর বৃক্ষ হিসেবে নিশ্চিন্তে লেবুগাছ লাগিয়ে ফেলনু। এবার লেবুর কাজ নিয়ে কথা বলি। জামের মতো লেবুও মহাগুনী! লেবু স্কার্ভি রোগ থেকে রক্ষা করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ মূল্যবান ফলটি যা দেহের ক্ষত নিরাময় ছাড়াও, রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতা বাড়ায়। লেবুতেও জামের মতো প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্টস থাকায়, দেহের ক্যানসারসহ পঙ্গুত্ব ও প্যারালাইসিসের হাত থেকেও আমরা রক্ষা পাই।
আমাদের দেশের প্রতিটি শিশুরও ভিটামিন সি’র অধিকার আছে। ওদের রোজ কম হলেও ২০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খাওয়ানো উচিত। ভাতের সাথে অল্প পরিমানে লেবু খাওয়ানোর অভ্যেস তৈরি করুন। দেখবেন ওদের ভিটামিন সি’র ঘাটতি কিভাবে কেটে গেছে। তবে, লেবু থাওযার নিয়ম মানতে হবে। লেবু সবসময় খেতে হবে ভরা পেটে। কেননা, লেবুতে প্রচুর সাইট্রিক অ্যাসিড রয়েছে। যাদের গ্যাসের সমস্যা, খালি পেটে এই টকফলটি ভুলেও খাবেন না। তারপরও, লেবুর পুষ্টিগুণও দারুন। একটি ১০০ গ্রাম ছোট্ট লেবুতে ৬০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি পাবেন। যা একটি আপেল থেকে ৩২ গুন ও কিছু আঙ্গুরের চেয়ে দ্বিগুন উপকারী উপাদান। এমন অপরিহার্য একটি লেবু যা সুস্বাস্থ্যের জন্যই নয়, শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতেও এই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলটির তুলনা নাই। ক্যান্সার প্রতিরোধ ছাড়াও, লেবু পাকস্থলী সুস্থ রাখে। শরীরের বিষাক্ত দ্রব্য বের করে দেয়। ফুসফুসের যত্ন নেয়। শরীরের লিপিড ও চর্বির মাত্রা কমায়। যে কোন ইনফেকশন ও ঠান্ডার বিরুদ্ধে কাজ করে। হাইপার টেনশন কমায়। ত্বকের যত্বে লেবুই একমাত্র মহা অ্যানটি সেপটিক। ব্যকটেরিয়ার সংক্রমণও দুর করে। ত্বক সুন্দর করে। বয়সের বলিরেখাও দূর করে। দাদ, চুলকানিতেও লেবুর রস বেশ উপকারী। লেবু মুখের দুর্গন্ধ দুর করে। দাঁতের হলুদাভাব কাটায়। ওজন কমায়। এমনকি লেবুরস ও লবন পানিতে শরীরের পিএইচের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গর্ভবতী মায়েদেরও লেবু খুব প্রিয়। এছাড়াও লেবুর এক চামচ রস যে কোন অ্যাজমা ও হাঁপানী রোগীর খুব কার্যকরী পথ্য। এই রস শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের শরীরে শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। লেবু মানসিক চাপ কমায়। একটি গবেষণায় বলা হয় – ক্যালসিয়াম অক্সলেট নামক পাথর গঠনেও বাধা দেয় লেবুর সাইট্রিক এসিড। ফলে এটি কিডনির পাথর সরাতেও খুব উপকারী বন্ধু। লেবু লিভারও ভালো রাখে। এবং যে কোন ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধী। লেবু চোখের সমস্যায়ও উপকারী। আর কবিরাজরাও বলেন, মূত্রনালীর যে কোন রোগেও লেবুর রস ও পানি একমাত্র টোটকা।
লেবু রুটেছি পরিবারের ছোট চিরসবুজ বা সম্পুরক উদ্ভিদের একটি প্রজাতি। বৈজ্ঞানিক নাম সাইট্রাস লিমন। টক স্বাদযুক্ত লেবুর রসে মুগ্ধ বাঙালীর প্রতিদিনের বাজার আর খাবারে লেবু একটি অপরিহার্য রসালো ফল। দেশে কাগজী লেবু ছাড়াও এখন সিডলেস ও নতুন অনেক ধরনের লেবু বাজার দখল করে আছে। তবে খুব সুগন্ধি লেবুর মধ্যে প্রধান লেবুই হলো ছোট্ট কাগজী লেবু, পাতি লেবু, মোসাম্বি লেবু, গন্ধরাজ লেবু। আর সিলেটি লেবু পরিবারের ভেতর পাবেন- পাহাড়ী, জারা, আদা জামির, সাতকরা, বারোমাসি, এলাচি ইত্যাদি লেবু। এছাড়াও নরসিংদীর বড় লেবু, টাঙ্গাইলের বহুবিচির রসালো লেবু। চিটাগংয়ের লম্বা লেবু। আরও বেশ কিছু প্রজাতির লেবু এখন আমরা বাজারে পাই। তবে লেবুর প্রধান এলাকাই সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চল। বৃক্ষালয় সিলেটি পাহাড়ী লেবুর বীজ সংগ্রহ করেছে। নিজস্ব ভুমি না থাকার দরুন বৃক্ষপ্রেমীদের কাটিং চারা বিতরণ করতে পারছে না সংস্থাটি। ভবিষ্যতে আরও অন্যান্য গবেষণাধর্মী বৃক্ষ লতা পাতা ফুল ফল নিয়েও পাঠকের পাশে থাকার প্রত্যাশা জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্ণধার। তিনি আরও জানিয়েছেন, নিজস্ব উদ্যোগেই তিনি একটি জমি ক্রয় করার জন্য চেষ্টা করছেন। গবেষণাকাজে বৃক্ষালয়’র একটি জমির বন্দোবস্ত হলেই- বিলুপ্তপ্রায় জীবজন্তু পশুপাখি বৃক্ষলতা ফুল ফল নিয়ে তিনি আরও নিরলস ভাবে নিজের আঙিনাতে আরও অনেক গবেষণা চালিয়ে যাবেন বলে আশা রাখেন। পাশাপাশি কাজ করতে চান পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়। ও সবুজায়ন নিয়ে।
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি