সবার বুকের ভেতর। এক ধরনের কঠিন ভয় ঢুকে গেছে। আমাদের চলার পথে। রোজকার এই জীবনে। ক’দিন ধরে যা ঘটে গেল বলেই, আজ, এই ধরনের একটি শিরোনাম। বেশ কয়েকটি আকস্মিক দুর্ঘটনা। পরপর দেশের মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আরও বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আমরা এখনও শিশু। এবং দুর্ঘটনা মোকাবেলায় বড়ই অসহায়।
‘সীতাকুন্ড কন্টেইনার ডিপোর বিস্ফোরণ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আগুন, গুলশান-২ আগুন ট্রাজেডী, এলিফেন্টরোডের ভবন বিস্ফোরণ, সর্বশেষ গুলিস্তান-সিদ্দিকবাজার ভয়াবহ ভবন বিস্ফোরণ’ কি প্রমাণ করে? ঘটনাগুলো একটা একটা করে ঘটে গেল। এবং খুব কম সময়ের মধ্যে। কত নিরীহ মানুষ আমরা হারালাম। যা সত্যি খুব দুঃখজনক। মাত্র দুইমাসের ব্যবধানে এত মানুষের প্রাণহানি মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর। যদিও সবই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সর্বশেষ রেকর্ড (১১ মার্চ: ২০২৩) হিসেব মতে ২৪ জন মানুষ এই সিদ্দিকবাজারের ভবন বিস্ফোরণেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কতগুলো পরিবার আজ হয়েছে আপনজন বঞ্চিত। হলো অভিভাবকহীন। আরও অন্য ঘটনার নিহত আহত সবার পরিসংখ্যান নাইবা বললাম। কথাতে একটাই। মানুষের জীবনের এই দুঃসময়ের দায় কার?
বিগত কয়েক বছরের নানান দুর্ঘটনায় আরও কত ভবন বিস্ফোরণ, ভবন ধ্বস ও আগুণের লেলিহান শিখায় মানুষ পুড়ে নিঃশ্চিহ্ন হয়েছে। একটি ঘটনারও সঠিক বিচার ও সুরাহা বলতে গেলে হয়নি। অবাধ ঘুষ বাণিজ্য আর দুর্নীতির ছত্রছায়ায় আইনের ফাঁক ফোকর গলিয়ে ভবন মালিক, আর রাঘববোয়ালরাই পাড় পেয়ে যায়। এবং বারবার। সে কারণেই একটি দুর্ঘটনার শোক কাটতে না কাটতেই, আরও একটি বড় অঘটন সহজে ঘটে যাচ্ছে। একটিকে থামাতে না থামাতেই আরও একটা বিপদ সামনে এসে যাচ্ছে। দুর্নীতির কপালে পেরেক ঠুকতে না পারলে, আবাসন পরিকল্পনায় কঠোর নীতি যতই করা হোক। নীতিমালার সুফল কখনও ভোগ করা সম্ভব হবে না।
প্রাকৃতিক বিপদ ও দুর্যোগ তো আর বলে কয়ে আসে না। বলে কয়ে যেটা আসছে। বেশির ভাগই কর্তৃপক্ষ ও মালিক শ্রেণীর পুরোপুরি ‘দায়িত্বের’ অভাববোধ। কান্ডজ্ঞানহীন ভবন মালিকরাই এখন এই দেশে সাধারণ নগরবাসীর জন্য সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর শ্রেণী। এছাড়াও ডেভলপারদের সাথে আঁতাত করে, দেশের আনাচে কানাচে, যে যেখানে পেরেছে, ব্যাঙের ছাতার মত দেদারছে উঁচু-বহুতল ভবন তৈরি করেই যাচ্ছে। আর মহল্লার ভেতরের চিত্র আরও ভয়ানক। এমনও সরু পথ আছে, যেখানে একটা রিকশা ঢুকলে, সামনে পেছনে মানুষের ১ ঘন্টা অপেক্ষা করা লাগে ! অথচ ঐ সব রাস্তাঘাটেও দেখবেন, কত রঙ বাহারী বহুতল ভবন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে ঠায় দাঁড়িয়ে ?
এই হলো আমাদের ‘আবাসন নিয়ম-নীতি’ ! যেন, আমাদের মুরুব্বিদের আচরণের মতই। ‘‘নাতী পুতিরা সিগারেট টান মারছে। মারুক না। সেই বয়সে তো আমরাও এমন ছিলাম। কথা গুলো ওমনই শোনায়। কিন্তু তামাক আর নিকোটিন যে নাতী-পুতিদের বক্ষ ছেদন করে দেবে। নিয়ে যাবে ক্যান্সারের জগতে। যেখান থেকে আর ফিরে আসবে না তার নাতী। সেই ভয় দাদাদের বুকে তো বিধাতা দেয়নি? ভবন নির্মাণেও যেন ইদানিং এমন মুরুব্বি সমাজ বিচরণ করছে। জমির মালিক আর ডেভলপার, তাদেরও যেন সেই একই গা সাড়া ভাব ! যেইখানে পারে হোক না উঁচু বড় রাজপ্রসাদ। হোক বাঙলার বুর্জ খলিফা ! নাগরিক জাহান্নামে যাক। আমরা বানাব উঁচুদালানের মার্বেল জান্নাত …’’
এখন বোঝাই যায়, রাজউকের অনুমোদনের পর ভবন মালিকরা প্রায়ই নির্মাণের সময় নির্দেশনার ধার ধারে না। আবার নির্মানের সময় ও নির্মাণের পরও ভবন নিয়ন্ত্রণকারী কোন তদারকি ও তাদের কাছে কোন কৈফিয়ত চাওয়া হয় না। আর নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোন ভূমিকা গ্রহণ ? সেটাও যেন অকল্পনীয় ! এজন্যই একজনের দেখা দেখি মালিক শ্রেণীরা এভাবেই রাজধানীর পরিবেশের জন্য হুমকি হচ্ছে। যার খেসারত ও চরম মূল্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। আগুণে পুড়ে, না হয়- বিস্ফোরণে ঝলছে, না হয়- ইটপাথরের নিচে পিষ্ট হয়ে মরছে অসহায় মানুষ। আরও একটা অবাক করার বিষয়। প্রতিটি ঘটনার পরই দেখা যায় এত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনের একটা কালচার। তাদের তদন্ত নামেই শুরু। সংবাদ সম্মেলনের পর সম্মেলন হয়। কিন্তু বিচার আইনে দোষী মালিকদের পরবর্তী আর কোন সংবাদ শুনতে পায় না জাতি। আকস্মিক পরিবারের কাউকে হারিয়ে অশ্রুঝরা মা ঠিকই তাকিয়ে থাকেন, শেষ বিচার দিনের প্রত্যাশায় …
লোভাতুর একশ্রেণীর আবাসন মালিক শ্রেণীর কব্জায় আজ আবাসন শিল্প কলুষিত। যা সত্যি, স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য বেমানান। এবং নীরিহ দেশবাসীর জন্য খুবই চিন্তার বিষয়। এই লজ্জা থেকে সরকারকেই আবাসন শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের বেড় করে আনতে হবে। তারা যেই বাণিজ্য-নীতিই অনুসরণ করুক। সেখানে জননিরপত্তার বিষয়টি রাখতে হবে প্রথম ভাবনায়।
আগুন বলেন, ভবন বিস্ফোরণ বলেন। সবই তো ভয়াবহ। প্রত্যেকটি অঘটনই তো মৃত্যুর মিছিল … এখনই যদি আমরা এসব অস্বাভাবিক দুর্ঘটনা রোধ না করতে পারি। তাহলে বিশেষ করে এই ঢাকানগরীই হয়ে যাবে একদিন ‘মৃত্যুপুরী’ ! কেননা, এখানে একটি বাড়ির গায়ে গায়ে আরেকটা বাড়ির কালচার। একটি বহুতল ভবনের দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখবেন। মাথাটা কেমন ঘুরে যায়। দেখবেন বড় বড় দালানের এই ঢাকা শহর এই বুঝি আমার ওপর হেলে পড়ল …। আল্লাহ্ মেহেরবান না করুন। সিরিয়া বা তুরস্কের চেয়েও তিনভাগ কমও যদি এই শহরটা একটা ঝাকুনি খায়। কোথায় যাব আমরা ? কে আসবে ইটপাথরের ভেতর থেকে আমাদের পিষে যাওয়া শরীরটাকে টেনে বের করবে ? এত ঝুঁকির মধ্যে আমাদের এই মানবজীবন। শহরের যে কোন দিক দিয়ে হাঁটলেও অজানা এক ভয় আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এই আগুন, এই বিস্ফোরণ, এই না ঘটে যায়- ভূমিকম্প … সাধে কি বিশেষজ্ঞরা আর সাংবাদিক মহল মানুষকে ভয়ের গল্প শোনায় ? আর টকশোতে গলা ব্যথা করছেন ?
‘আমরা একটি ভবন করব, নির্মাণ নিরাপত্তায় কোন বাধা আছে কিনা। কারো কোন প্রকার দ্বিমত আছে কিনা, নির্মাণ পণ্যের বিষয়ে এলাকাবাসীর কোন ভেট্যু আছে কিনা,’ ইত্যাদি বিষয় কয়জন মেনে চলি ? ভবন, বহুতল ভবন করছি সরকারি রাস্তা পুরোটা দখল করে। ইটা বালি রড সুরকির গোডাউন তৈরি করে। কখনও নামকরা ডেভলপার কোম্পানীর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে। পথচারী এই পথ দিয়ে নির্ভিঘ্নে যেতে পারবে কি পারবে না। সেটা উঁচু দালান তৈরির পর বোঝা যাবে ? উন্নত মনমানসিক নাগরিক সমাজ আর আমরা আম জনতার মধ্যে এই তো ফারাক।
সরকারের জন্য তাই ভবন নির্মাণ বিষয়টি এখন একটি চ্যালেঞ্জে রুপ নিয়েছে। কেননা, জাতির প্রত্যাশা প্রশাসনের কাছেই থাকে সবচেয়ে বেশি। সিদ্দিকবাজারের জন্য তো সাথে সাথেই সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টি খুব ভালো লেগেছে। তবে বিস্ফোরণকৃত বেঁচে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পড়ে থাকা রোগীর আর্তচিৎকার আর মৃতস্বজনদের আহাজারির কাছে সব অনুদানই তুচ্ছ। আমরা অনুদান চাই না। আমরা চাই- সুন্দর জীবন। নিরাপদে চলাফেলার গ্যারান্টি। ঘরের মানুষ কাজ সেরে সুস্থভাবে তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারে। শুধু- সেই নিশ্চয়তা।
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি
(ছবি: রনি, সম্প্রীতি ও সৌহাদ্য)