আসছে শীত। আর এরই সঙ্গে শীতের বিভিন্ন রোগবালাই। আর তাই এ সময়ে চাই বাড়তি সতর্কতা। রোগবালাই রোধে আগেভাগে নেওয়া দরকার কিছু প্রস্তুতি। আর এ সম্পর্কে জানাচ্ছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক- ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
সর্দি-কাশি
শীতে কমন কোল্ড বা সর্দি-কাশি লেগেই থাকে, বিশেষ করে নাক বন্ধ হওয়া, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরা এবং হাঁচিও হয় ঘন ঘন। মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা ও ম্যাজ ম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দার পাশাপাশি হালকা জ্বরের প্রাদুর্ভাবও দেখা দেয়।
করণীয়
⬤ প্রথম কাজ হলো ঠান্ডা যাতে না লাগে সেদিকে বেশি খেয়াল রাখা, বিশেষ করে সকাল, সন্ধ্যা এবং রাতে সবাইকে শীতের পোশাক বা গরম জামাকাপড় পরে থাকা উচিত।
⬤ টয়লেট ও গোসলের সময় বেশি ঠান্ডা পানি ব্যবহার না করা।
⬤ শীতে ধূলিকণা, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে। এ সময় মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।
টনসিলাইটিস
গলা ব্যথা, স্বরভঙ্গ, কণ্ঠনালির নানা সমস্যাসহ টনসিলের প্রদাহ বা টনসিলাইটিস বেশি হয় শীতে। সাধারণত ভাইরাসজনিত কারণে এই রোগ বেশি হয়।
এ ক্ষেত্রে ওষুধ সেবনের খুব একটা দরকার পড়ে না।
করণীয়
⬤ টনসিলাইটিসের সমস্যা যাদের রয়েছে, তারা লবণ মেশানো হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করলে আরাম পাবেন।
⬤ ঠান্ডা পানি পরিহার করে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন এবং গলায় গরম কাপড় বা মাফলার জড়িয়ে রাখুন। সেই সঙ্গে মাউথওয়াশ দিয়ে কুলি করলে ভালো থাকা যায়।
⬤ জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল ও সর্দি-কাশি থাকলে অ্যান্টিহিস্টামিন সেবন করা উচিত।
⬤ কানে ব্যথা হলে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিত্সা নিন।
শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, সিওপিডি
অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, সিওপিডি জাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগগুলো শুধু শীতকালীন রোগ না হলেও শীতে এসব রোগের প্রকোপ কিছুটা বেড়ে যায়। শীতের সময় দিনের মধ্যভাগে ধুলাবালি, কলকারখানা বা যানবাহনের কালো ধোঁয়া থেকে বাতাসে ঝুলন্ত কণায় পরিবেশদূষণ বেশি হয়। অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীরা শীতে বেশি কষ্ট পায়।
যেকোনো বয়সী মানুষের হাঁপানি হলেও বয়স্ক মানুষেরা ভোগেন বেশি। অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জটিলতা বা ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে। শীতের সময় অ্যাজমা আক্রান্তদের কিছুটা নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করা উচিত।
করণীয়
⬤ শীতের পুরো সময়ই প্রচুর পানি পান করলে শ্বাসনালিতে মিউকাস তৈরি হয়ে রোগ-জীবাণু বের হয়ে যায়।
⬤ শীতে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, সিওপিডির রোগীদের পর্যাপ্ত মোটা কাপড়ের বন্দোবস্ত করতে হবে।
⬤ ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করুন, বিশেষ করে শোবার ঘরটি উষ্ণ রাখার চেষ্টা করুন।
⬤ এসব রোগের ট্রিগারগুলো জেনে সতর্কভাবে চলুন।
⬤ অ্যাজমা রোগীদের খুব ঠা্লা আবহাওয়ায় বাইরে বের না হওয়া, ধুলাবালি, পশুর লোম, ফুলের রেণুর সংস্পর্শ পরিহার, চিকিত্সকের পরামর্শে আগে থেকেই ওষুধ ও ইনহেলারের ডোজ ঠিক করে নেওয়া উচিত।
⬤ যদি কোনো কারণে অ্যাজমা পরিস্থিতির হঠাত্ অবনতি হয়, তখন যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন, নেবুলাইজার প্রয়োগসহ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের অধীনে চিকিত্সা দিতে হবে।
বাত ব্যথা
আর্থ্রাইটিস বা বাতের সমস্যা শীতের সময় বেড়ে যায়। মূলত বয়স্কদেরই এই সমস্যা হয় বেশি, বিশেষ করে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াসিটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস রোগীদের শীতের সময় চলাফেরা বা মুভমেন্ট কম হয় বলে ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়।
করণীয়
⬤ সব সময় হাত ও পায়ের মোজা পরিধান করুন।
⬤ ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে দেহের অতিরিক্ত ওজন থাকলে তা কমিয়ে আনুন।
⬤ একটানা অনেকক্ষণ বসে না থেকে যতটুকু সম্ভব ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করুন।
⬤ যথাসম্ভব গরম উত্তাপে থাকুন।
⬤ চিকিত্সকের পরামর্শ নিন।
⬤ প্রয়োজনে গরম পানি ব্যবহার করুন।
⬤ গরম সেঁক দিন বা ফিজিওথেরাপি নিন।
ত্বকের সমস্যা
শীতের রুক্ষতা আর শুষ্কতা ত্বকে কিছু সমস্যা তৈরি করে থাকে। শীতকালে ত্বকের প্রধান সমস্যা হলো, ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে যাওয়া। দেখা যায়, কারো হয়তো ত্বক ছিল মসৃণ ও প্রাণবন্ত; কিন্তু শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই ত্বকই হঠাত্ হয়ে ওঠে রুক্ষ। ফলে অনেকের ত্বকে র্যাশ, সোরিয়াসিস কিংবা ড্রাই একজিমার সমস্যা বাঁধতে পারে।
করণীয়
⬤ শীতে ত্বকের সমস্যা থেকে বাঁচতে ধরন অনুযায়ী ক্রিম, লোশন, পেট্রোলিয়াম জেলি, গ্লিসারিন, ময়েশ্চারাইজার ইত্যাদি ব্যবহার করুন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তৈলাক্ত ত্বকে অতিরিক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা ঠিক হবে না। এতে ত্বকের সেরামগ্রন্থি থেকে নিঃসরণ বেড়ে ব্রণ ও খুশকির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
⬤ খাদ্যতালিকায় রাখুন উপকারী ভিটামিন ‘সি’, ‘এ’ ইত্যাদি খাবার।
⬤ বেশিক্ষণ রোদে থাকবেন না এবং কড়া আগুনে তাপও পোহাবেন না।
হৃদরোগ
তীব্র শীতে ঠান্ডা আবহাওয়ায় রক্তচাপ বেড়ে গেলে হূদযন্ত্রের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এতে হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা ঘটতে পারে, বিশেষ করে ভোরের দিকে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের ঝুঁকি একটু বেশি।
করণীয়
⬤ এ সময় শীতের অন্যান্য সাধারণ নিয়ম মেনে চলা ও সতর্ক থাকা উচিত।
⬤ শোবার ঘরের পরিবেশ যথাসম্ভব উষ্ণ রাখার ব্যবস্থা করা এবং শীতে কুয়াশার মধ্যে নয়, বরং একটু রোদ উঠলেই বাইরে বের হয়ে হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করা ভালো।
⬤ সালাদ, সিজনাল ফলমূল বেশি খাওয়া উচিত। কারো হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে মনে হলে জিবের নিচে নাইট্রেড গ্লিসারিন দ্রুত স্প্রে করা অথবা দ্রুত হূদরোগসংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যেতে হবে।
হাইপোথার্মিয়া
শীতের মাত্রা তীব্র হয়ে গেলে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। অর্থাত্ যখন শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হারে কমে যেতে শুরু করে, ঠিক তখনই হাইপোথার্মিয়া দেখা দেয়। শিশু, বয়স্ক ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের এটি হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা কম। হাইপোথার্মিয়া হলে শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসে। শরীরে তাপ উত্পাদন কম হওয়ায় হাত-পা কুঁকড়ে যায়, এমনকি শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে।
করণীয়
⬤ হাইপোথার্মিয়া প্রতিরোধে পর্যাপ্ত গরম কাপড়সহ হাত মোজা, পায়ের মোজা পরতে হবে।
⬤ সব ক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। গরম পানি পান ও গরম খাবার খেতে হবে।
⬤ রুম গরম রাখতে আগে থেকেই রুম হিটারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এতে ত্বক যেন একেবারে শুষ্ক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
⬤ এই রোগের যেকোনো লক্ষণ যেমন – শরীরে কাঁপুনি, অসারতা, আড়ষ্টতা, দিকভ্রান্ততা, অ্যামনেশিয়া ইত্যাদি দেখামাত্র জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আরো কিছু সতর্কতা
বয়স্কদের নড়াচড়া, হাঁটাচলা ও কাজকর্ম অনেক কম হয়। ফলে শরীরে উত্তাপ সৃষ্টি ও তাপ ধরে রাখার ক্ষমতাও কমে যায়। তাই এ সময় শরীর গরম রাখার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যেমন –
⬤ পাকা মেঝের ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে ঘরে চটি বা স্পঞ্জ পায়ে দিন। হাত ও পায়ে মোজা পরিয়ে রাখুন।
⬤ ত্বক, ঠোঁট, হাত-পা, নখসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচতে বিভিন্ন ক্রিমসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করুন।
⬤ চাদর, বালিশের কাভার নিয়মিত পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে দিন।
⬤ শোবার ঘরটির দিকে নজর দিন। বিছানা যেন শীতল না হয়ে যায়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখুন।
⬤ রুম হিটার ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করবেন। কেননা এতে চামড়ায় সমস্যা দেখা দেয়।
⬤ অজু, গোসলসহ নানা কাজেও গরম পানি ব্যবহার করুন, এতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।
⬤ শীতের সময় রাত জাগা ক্ষতিকর। তাই দ্রুত শুয়ে পড়ার অভ্যাস করুন। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
⬤ জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথাসহ অন্য যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিত্সকের শরণাপন্ন হোন।