দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে বসছেন। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি এতে আলোচনায় প্রাধান্য পাবে।
বিশেষ করে ভারত থেকে বাংলাদেশে টিকা প্রাপ্তি এবং কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে সহযোগিতার রূপরেখা দিতে পারেন দুই নেতা।
বাংলাদেশের তরফে সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, অশুল্ক বাণিজ্য বাধা দূর করা এবং ভারতীয় ঋণের বাস্তবায়নে গতি আনার বিষয়ে জোর দেয়া হবে।
বৈঠকে ছয়টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও প্রটোকল সই হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৈঠক শেষে ঢাকা ও দিল্লি একটি যৌথ বিবৃতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নরেন্দ্র মোদির মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। মহামারীর কারণে তার সফর বাতিল হয়।
দুই নেতার ভার্চুয়াল বৈঠক আজ বেলা ১১টায় শুরু হবে। এতে দুই প্রধানমন্ত্রী তাদের বক্তব্য দেবেন। পরে চুক্তি, এমওইউ ও প্রটোকল সই হবে। তারপর কিছু প্রকল্প যৌথভাবে উদ্বোধন করবেন তারা।
বঙ্গবন্ধুর ওপর ভারত একটি স্মারক ডাকটিকিট করেছে যা বৈঠকে প্রকাশ করা হবে। এর আগে মহাত্মা গান্ধীর ওপর স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ।
বৈঠকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহাত্মা গান্ধীর ওপর একটি অনলাইন জাদুঘর প্রদর্শন করা হবে। আগামী বছর বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে।
ওই বছরই বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কেরও সুবর্ণজয়ন্তী। ফলে উদযাপনে দু’দেশের যৌথ কর্মসূচিও থাকবে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতারা ১৭টি মোটরগাড়িতে যে সড়কে ভারত থেকে মুজিবনগর এসে শপথ পড়েছিলেন, ওই সড়কটিকে স্বাধীনতা সড়ক নামকরণ করে তা দু’দেশের জনগণের চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ।
সড়কের একটি বড় অংশ ভারতের নদীয়া ও উত্তর চব্বিশপরগনা জেলা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত গিয়েছে। ওই অংশে রাস্তার অবস্থা ভালো না।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভার্চুয়াল বৈঠকে নয়টি চুক্তি, এমওইউ ও প্রটোকল সই করার কাজ শুরু হলেও তার সবকটি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। তবে অন্তত ছয়টি দলিল সই করার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
এসবের মধ্যে আছে আন্তঃসীমান্ত হাতি সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রটোকল। এর আগে দু’দেশের মধ্যে বাঘ সুরক্ষায় প্রটোকল হয়েছিল। ভারতের অনেক বন্য হাতি প্রায়ই খাবারের সন্ধানে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।
তারা লোকালয়ে ঢুকে বাড়িঘর ভাংচুর ও মানুষকে আহত করে। অনেক সময় গ্রামের লোকেরা হাতির ওপর পাল্টা হামলা চালায়। হাতি সুরক্ষায় তাই প্রটোকল সই হচ্ছে।
বরিশাল নগরীর স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় ভারতের সহায়তা বিষয়ে একটি এমওইউ হতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধান নির্বাহীদের ফোরামের মধ্যে সহযোগিতায় এমওইউ হতে পারে।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু জাদুঘর এবং দিল্লির একটি জাদুঘরের মধ্যে সহযোগিতার সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এ ছাড়াও কৃষি ক্ষেত্রে সহযোগিতা চুক্তিও হতে পারে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে দাবি জানানো হতে পারে। এ ছাড়াও তিস্তাসহ অভিন্ন নদীসমূহের পানিবণ্টন নিয়েও আলোচনা তুলবে বাংলাদেশ।
তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির কারণে ২০১১ সালে চুক্তিটি সই হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারত শিগগির তিস্তার পানিবণ্টনে কারিগরি কমিটির বৈঠক করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে পারে।
শর্তের জালে ভারতের ঋণের এলওসি (লাইন অব ক্রেডিট-এলওসি) থেকে অর্থছাড় হচ্ছে খুব কম। এ ব্যাপারে শর্ত শিথিল করে কীভাবে ঋণের টাকা ছাড় করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হবে।
এ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে আট বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাস্তবায়নে গতি কম থাকায় শর্ত নতুন করে রিভিউ চায় বাংলাদেশ। আজকের বৈঠকে দুই নেতা এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠকের পুরো অনুষ্ঠানটি সর্বোচ্চ আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী হবে।
ফলে এতে এসব বিষয় কীভাবে আলোচিত হবে-জানতে চাইলে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশ এর মধ্যে এসব তোলার চেষ্টা করবে।
তবে সুযোগ না পাওয়া গেলে ঢাকা-দিল্লি যৌথ বিবৃতিতে এসবের উল্লেখ থাকবে। ফলে এবারের যৌথ বিবৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের তরফে সংযোগ বৃদ্ধির বিষয়ে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সংযোগ পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে রেল ও সড়কপথে কানেকটিভিটি প্রকল্প বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে।
এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমলে যেসব সংযোগ ছিল সেগুলো পুনরায় চালুর বিষয় গুরুত্ব লাভ করবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ি পর্যন্ত রেললাইন চালুর বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান সম্প্রতি ওই অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে রেলপথ স্থাপন করার অগ্রগতি দেখেছেন।
প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলক এই রেলপথে মালবাহী ট্রেন চালানোর সম্ভাবনা রয়েছে। হলদিবাড়ি থেকে এই রেলপথ ভারতের বিদ্যমান রেললাইনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাবে।
অপরদিকে চিলাহাটি থেকে এই পথে ঢাকা পর্যন্ত আসা যাবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে ভারতের হলদিয়া বন্দর পর্যন্ত সড়কপথে সংযোগ স্থাপনের কথাবার্তা চলছে।
পার্বতীপুর থেকে গোয়াহাটি পর্যন্ত রেল সংযোগ স্থাপনের চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে। ভারত ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করেছে।
এই সেতু নির্মাণের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। দু’দেশের মধ্যে আলোচনায় নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং জঙ্গি দমনে সহায়তা উঠতে পারে।
লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষের পর এ অঞ্চলে বড় এই দু’দেশের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর।
কারণ, দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্ক রয়েছে। আঞ্চলিক এমন উত্তাপের মধ্যে ভারত প্রসঙ্গটি আলোচনায় তোলে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট কৌতূহল রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ চায় দুই দেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান করুক।
এ ছাড়াও বিজেপি সরকারের ভারতের অভ্যন্তরে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) এবং নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে বাংলাদেশে অস্বস্তি আছে। শীর্ষ বৈঠকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইঙ্গিতে হলেও নিজেদের মনোভাব জানানোর চেষ্টা করবে।