মুহ্তাছিম সাকিব। যার আরবী নামের অর্থ: একজন উজ্জ্বল মানুষ । আজকের বিশেষ প্রতিবেদনে শুনব আমরা, এই উজ্জ্বল কিশোরের গল্প …
সাকিব, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানার পৃথিমপাশা গ্রামের কামাল আহমদের বড় ছেলে। একজন বৃক্ষপ্রেমী। সবুজের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। খাঁটি গ্রামের মাটির মানুষ হওয়া যার স্বপ্ন। ভালো মনের মানুষদের অনুপ্রেরণায় সে গ্রামের পরিবেশেই বড় হয়েছে। নিজের গ্রাম থেকেই সে আলিম পাশ করেছে। ইচ্ছে ছিলো- সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় এ বছর ভর্তি হবে। কিন্তু আর্থিক টানপোড়নে দুরে থেকে লেখাপড়ার ইচ্ছেটা তার আর হয়ে উঠেনি। সে নিজের গাঁয়ের মাদ্রাসাতেই ফাজিলে (অনার্স লেভেল) ভর্তি হয়েছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাকিব টিউশনি করে। বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার আর্থিক সহযোগিতায় ও নিজের পড়ার খরচের কথা ভেবে সে দমে থাকে না। মাঝে মধ্যে পরিচিত জনদের কাছে পার্টটাইমের চাকরির জন্যও তাকে অনেক ঘুরাঘুরি করতে হয়েছে। সবুজপ্রেমী এই চিরতরুণের পথ খুলে যায়, বলা চলে এই সবুজায়নের মাধ্যমেই। সবুজায়ন নিয়ে কাজ করা ‘বৃক্ষালয়’ এর অনুপ্রেরণায় সাকিব নিজের মেধাকে কাজে পরিণত করার চেষ্টায় মনোনিবেশ করে। নিজেদের সেইরকম কৃষি জমি না থাকায় গ্রামের নিকটজনের থেকে সে তিন হাজার টাকা চুক্তিতে এক বছরের জন্য একটি ছোট্ট জমি বর্গা বা লিজ নেয়। তার মামাতো ভাই রুহেলও তার চিন্তাধারায় ও সবুজ সৃষ্টিতে তাকে সহযোগিতা করছে। আশা আছে, একমাত্র ছোটভাইটিও মোবাইল গেমের আসক্তি থেকে বেড়িয়ে এসে তাকে সহযোগিতা করবে। বাবা মাও সবসময় এই কিশোরকে অনুপ্রেরণা যোগায়। নিজের ঐকান্তিক ইচ্ছেতে সে গড়ে তুলবে একটি কৃষি খামার। ছোট্ট পরিসরে সবে শুরু। আর এই শুরুতেই সাকিব বাজার থেকে দেশি সাধের লাউ, টমেটো, বেগুন, বিভিন্ন জাতের মরিচ ছাড়া সিলেটের এক প্রকার ফরাস ডালের বীচ কিনে এনে, চাষাবাদ শুরু করে। এক জমিতে এতগুলো ফলনের তার নতুন চিন্তাধারা তাকে বেশ আবেগতাড়িতও করে।
যেমন আইডিয়া তেমন এই কিশোরের কাজ। ঢাকার এক আত্মীয় থেকে সে ৫ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে। এরপর গ্রামে তার এই নতুন ‘কৃষি বিপ্লব’ শুরু । আর্থিক সংস্থান যোগাড় করেই সে পর্যায়ক্রমে বাজার থেকে বীচ, চারা ও সারসহ নানান কৃষি উপকরণ কিনে আনে। নিজের দৈহিক শক্তি তার প্রধান সম্পদ । দিনরাত জমিন আর ফসলের সাথে শুরু হয় তার বোঝাপড়া। পটাস, ইউরিয়া ও গোবর সারে তার হাতে লাগানো- ‘সাধের লাউ’ বেশ সুন্দরভাবেই সবুজের সয়লাব হয়ে যায়। গ্রামের মানুষের নজরে চলে আসে তার সবুজ এই কৃষি খামার। শীতের দিন। মাটি ঠান্ডা থাকলে লাউ গাছে বেশি পানি দিতে হয় নাই। তা না হলে লাউ গাছের নিয়মানুসারে রোজই পানি দিতে হয়। সে বহু কষ্টে তার সবজি বাগানে পানির ব্যবস্থা করে গেছে। গাছ লাগানোর একমাসের মাথায় সাকিবের লাউ গাছের মাচাং ভরে ওঠে সবুজে সবুজে। তরুণকিশোর সাকিবের দেহমনে অনাবিল আনন্দ দেখে কে ? তার বুক ভরে ওঠে ‘সাধের লাউয়ের সাথে পুরো সবজি চাষের’ নতুন এক পরিকল্পনার সফলতায়। মুখে হাসি ফুটে ওঠে এই যুবকের পুরো পরিবারে। এখন রোজই সাকিব কম হলেও ৫ টি লাউ বাজারে বিক্রি করতে পারছে। স্থানীয় রবির বাজার হাটে একটি লাউ ৩০ টাকা করে অনাসায়ে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন লেখার সময় সাক্ষাৎকারে সাকিব জানিয়েছে, সে ইতিমধ্যেই তার ঢাকার আত্মীয়র সহযোগিতাপ্রাপ্ত লোনও পরিশোধ করে ফেলেছে। সে আশায় আছে, টমেটো-বেগুন-মরিচ-ফরাস ডালও আশানুরুপ বাম্পার ফলন পাবে। সাকিব আরও জানায়; সবুজায়ন প্রকল্প ‘বৃক্ষালয়’ এই কিশোরের পাশে আছে। সবার সহযোগিতায় আগামীতে তার এই ‘কৃষি বিপ্লব’ পৃথিমপাশা গ্রামকে আরও আলোকিত করবে। শুধু মৌলভীবাজার জেলা নয়, এই তুরুণের গল্পটা হতে পারে সারা গ্রাম বাংলার বেকার যুবকদের জন্য একটি অন্যতম ও অনন্য দৃষ্টান্ত। সাকিরের এই গল্পের অনুপ্রেরণায় তরুণ প্রজন্ম অযথা সময় নষ্টের কালচার থেকে সরে এসে, নতুন নতুন মাইলফলক সৃষ্টিতে দেশকে এগিয়ে নিবে। এটাই জাতির প্রত্যাশা। সবুজায়নের জয় হউক …
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি