ঘটনার ১৮ মাসের মাথায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে। সোমবার (৩১ জানুয়ারি) ঘোষণা হবে এ রায়। এরই মধ্যে কক্সবাজার আদালত চত্বরে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৃষ্টির ৩৮ বছরের ইতিহাসে এ প্রথম এতো দ্রুত কোনো হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হবে।
এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি কোনো মামলায় এতো কম সময়ে অভিযোগপত্র গঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের নজির নেই। তেমনি নজির নেই এতো বিপুল সংখ্যক সাক্ষী নেওয়ার। সবকিছু যেন অবিশ্বাস্য গতিতেই এগিয়েছে। তাই সবার দৃষ্টি এখন এ রায়ের দিকে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম জানান, সোমবার বিকেল ৩টার দিকে বিচারক এ মামলার রায় ঘোষণা করতে পারেন। করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় আদালত বন্ধ থাকার পরও মামলাটি দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হয়েছে।
তিনি বলেন, মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে চার্জশিটভুক্ত ৮৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। বিশাল তালিকার এ সাক্ষ্য-জেরা চ্যালেঞ্জিং হলেও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দ্রুততার সঙ্গে মামলাটি শেষ করতে চেষ্টা করেছি। এখন আশা করছি, রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।
অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করছেন। তাদের অন্যতম আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘আমরাও চাই সিনহা হত্যার ঘটনায় ন্যায়বিচার হোক। যারা প্রকৃত দোষী তাদের শাস্তি হোক। তবে কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পান।’
মামলার রায়ে প্রত্যাশা সম্পর্কে সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, ‘আমার ভাইকে যারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের সবাইকে যেন সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ড যেন আর না ঘটে। অপরাধ করে কেউ যেন পার না পায়। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়— এটাই রায়ে প্রমাণ হোক।’
এ বিষয়ে কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে যেন দেশ থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিলুপ্ত হয়— সেই প্রত্যাশা রাখছি। একই সঙ্গে বিগত সময়ে মেরিন ড্রাইভ রোডে যত কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে, সবগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হোক— এমন দাবি রাখছি।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর বাজারের কাছে পুলিশ চেকপোস্টে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকতের গুলিতে নিহত হন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারক তামান্না ফারাহ’র আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলার তদন্তভার দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫-কে।
২০২০ সালের ৬ আগস্ট ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরও সাত জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে। পাশাপাশি সিনহা নিহতের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে অতিরিক্ত ডিআইজি এবং লে. কর্নেল মর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তাকে সদস্য করে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়।
এ মামলায় চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষীসহ অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-১৫-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের তথ্যমতে, ২০২১ সালের ২৭ জুন জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার চার্জ গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিচারকাজ শুরু হয়। ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে দুই জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় দফায় ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় চার জনের। তৃতীয় দফায় ২০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে জেরা সম্পন্ন হয় আট জনের। চতুর্থ দফায় ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা করা হয় ছয় জনের। পঞ্চম দফায় ১০ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। ষষ্ঠ দফায় ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় ২৪ জনের।
সপ্তম দফায় ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ছয় জন সাক্ষ্য দেন। এদের মধ্যে পাঁচ জনের জেরা সম্পন্ন হলেও তদন্ত কর্মকর্তার জেরা অসম্পন্ন ছিল। সর্বশেষ অষ্টম দফায় ২৯ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। এরপর ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। সর্বশেষে ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন আদালত।