সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহরে কোনো কোনো এলাকায় বন্যার পানি কিছুটা কমলেও সার্বিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি নেই। বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। সিলেট নগরীর উপশহর পানিতে টইটুম্বুর। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার ৯০ ভাগ মানুষ এখনো পানিবন্দী। হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার ও সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে দ্রুত পানি বাড়ছে। হবিগঞ্জের খোয়াই, মৌলভীবাজারের মনু সহ আশপাশের নদীগুলোর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের অবস্থাও ভয়াবহ।
সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার ২৪টি উপজেলায় পানিবন্দী অর্ধকোটি মানুষের সাথে এখন নতুন করে পানিবন্দীর সংখ্যা বাড়ছে। বন্যায় অনেক স্থান থেকে মৃত্যুর খবরও আসছে। সিলেটে টিলা ধসের ঘটনাও ঘটেছে। মঙ্গলবার (২১ জুন) পানিবন্দী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সরেজমিনে দেখতে সিলেটে পরিদর্শনে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সূত্র জানায়, হেলিকপ্টার যোগে তিনি সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার্তদের প্রকৃত অবস্থা দেখবেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের সংবাদে বানভাসী মানুষের মধ্যে কিছুটা আশা সঞ্চার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে ব্যস্ত রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম সোমবার (২০ জুন) সন্ধ্যায় ইত্তেফাককে বলেন, ‘আগামী দুই-একদিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা দেখছি না। কানাইঘাটে সুরমা ও অমলসীদে কুশিয়ারা নদীর পানি সকাল থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে বিকাল ৩টায় বিপৎসীমার ১ দশমিক ২২ সেন্টিমিটার, অমলসীদে কুশিয়ারা ১ দশমিক ৮৫ সেন্টিমিটার, সিলেটে সুরমা দশমিক ৫৪ সেন্টিমিটার, শেওলায় অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিনি বলেন, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি থামলে এখানে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে।
বন্যার মাঝে আরও একটি দূর্যোগ টিলাধস। গত সিলেট এমসি কলেজে টিলা ধসে পড়ে। পরে সারিসারি বাঁশ গেড়ে তা ঠেকানো হয়। গত মাসেও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে টিলা ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সিলেট বিভাগের টিলাগুলোতে ভূমিধস হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বৃষ্টিপাতের কারণে এমন অনেক স্থানেই মাটি নাজুক হয়ে গেছে।
এদিকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ও বাসাবাড়িতে আটকে পড়া বানভাসি মানুষেরা বিশুদ্ধ পানি, খবার, ওষুধ, ও মোমবাতি বা জ্বালানির সংকটে ভুগছেন। বিশেষ করে শিশুখাদ্য ও দুধের সংকটে মায়েরা চরম বিপাকে। আশ্রয় শিবিরে প্রসূতি নারীরা পড়েছেন মহা সংকটে। অনেকেই বলেছেন নারী-শিশু, বৃদ্ধ ও প্রসূতিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
গত শুক্রবার থেকে সিলেট ও সুনামগঞ্জে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বন্যাকবলিতদের উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে। তাদেরকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও বিভিন্ন স্থানে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। এমনকি খিচুড়ি ও পোলাও-মাংসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় প্রয়োজন।
সিলেটের ১৩টি উপজেলা, ৫টি পৌরসভা ও সিটি এলাকার জন্য জেলায় এ পর্যন্ত ৪৯৭টি আশ্রয় কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেছেন ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ জন। আশ্রয়গ্রহণকারী গবাদিপশুর সংখ্যা ৩১ হাজার। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, সেনাবাহিনীর মোট ১৩টি ব্যাটালিয়ন উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া, সেনাবাহিনীর ৬০টি বোট উদ্ধার, চিকিৎসা, ত্রাণ, নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ণ ও বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে নিয়োজিত আছে। নৌবাহিনীর ১০০ জন সদস্য ১২টি নৌকা নিয়ে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে রয়েছে।
জেলা প্রশাসক জানান, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ৬১২.৪২০ মেট্রিক টন চাল, ৮১১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার, নগদ ৯২ লক্ষ টাকা ও ২০ লাখ টাকার শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে রবিবার বিকেলে আরো ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড কাজ করছে। বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টারও ওসমানী বিমানবন্দরে অবস্থান করে জরুরী কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
তিনি বলেন, বন্যার্তদের খাবারের ব্যবস্থা করা এখন মূল চ্যালেঞ্জ। ‘মানুষ কষ্টে আছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ত্রাণের কোন ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত চাল ও অর্থ রয়েছে। খাদ্যগুদামগুলোর সামনে পানি। ত্রাণ বিতরণ এখন পর্যন্ত শুকনো খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু, বৈরী পরিবেশের কারণে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা যাচ্ছে না।
সুনামগঞ্জ শহরের মূল সড়ক থেকে কিছুটা পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু পানি কমছে না ডুবে যাওয়া সরকারি, বেসরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ পাড়া মহল্লাগুলো থেকে। প্লাবিত রয়েছে সুনামগঞ্জ সদর সহ ১২ টি উপজেলা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার। পানিবন্দী রয়েছেন ৫ লাখেরও বেশি মানুষ। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন, সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে রযেছে। বন্যাকবলিতদের সহায়তায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন। প্রায় লক্ষাধিক মানুষ ৪৫০টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার্তদের সহায়তা করতে জেলা প্রশাসনের সাথে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ কাজ করছে। সুনামগঞ্জে ইতোমধ্যে ৪৫০ মেট্রিক টন চাল ও ৫ হাজার বস্তা শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ৪০ হাজার মানুষকে রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে।
সিলেটের সাথে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। সড়কের ওপরে এখনো পানি থাকায় ভারী যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ এখনো বন্ধ। যোগাযোগের একমাত্র বাহন নৌকা, যেটিতে আকাশসম ভাড়া চাইছেন মাঝিরা। দুই ঘণ্টার জন্য নৌকা ভাড়া করতে এক লাখ টাকা চাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এদিকে রবিবার থেকে সিলেটে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে, তবে বিমান চলাচল পুরোদমে চালু হতে আরও সময় লাগবে। রবিবার রানওয়ের পানি নামতে শুরু করে, সোমবার পুরোপুরি নেমে যায়। তবে এখনো রানওয়ের অ্যাপ্রোচ লাইট জ্বালানো সম্ভব হচ্ছে না, যে কারণে বিমান অবতরণ সম্ভব নয়। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বিমানবন্ধন পরিদর্শন শেষে জানিয়েছেন, রানওয়ে পানিতে ডুবলেও বিমানবন্দরের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। অ্যাপ্রোচ লাইটগুলো থেকে পানি সরে গেলে বিমান ওঠা-নামা শুরু করতে পারবে।