২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সন্ধ্যা ৬:২৮
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / সন্ধ্যা ৬:২৮

শেয়ারবাজারে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের অবিশ্বাস্য দাম উঠেছে।

শেয়ারবাজারে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের অবিশ্বাস্য দাম উঠেছে। লেনদেনের দ্বিতীয় দিনে ৩০২ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানির দাম ১১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

এর ফলে কোম্পানির উদ্যোক্তাদের শেয়ারবাজার থেকে আরও ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি তুলে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর ক্রমেই অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। যা পুরো বাজারের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথমত, সীমাহীন অতিরিক্ত দামে কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মাত্র দশমিক ৯৭ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। সবকিছু মিলে আগামীতে বিনিয়োগকারীদের জন্য মরণফাঁদ হতে যাচ্ছে ওয়ালটন।

বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ওয়ালটন একটি পরিচিত কোম্পানি। কিন্তু ১ শতাংশেরও কম শেয়ার নিয়ে কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত হতে দেয়া উচিত হয়নি।

কারণ এতে বাজারে কারসাজির সুযোগ তৈরি হয়। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অবশ্যই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সময়ে বাজারে একটি বহুজাতিক কোম্পানি খুব কম শেয়ার দিয়ে বাজারে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদের ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে বাধ্য করেছিলাম।

তার মতে, ওয়ালটনের শেয়ারের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে কোনো পক্ষ জড়িত থাকলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

বিষয়টি নিয়ে ওয়ালটনের কোম্পানি সেক্রেটারি পার্থ প্রদীপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা ইস্যুয়ার কোম্পানি। বাজারের লেনদেন নিয়ে কিছু বলা আমাদের জুরিসডিকশনের (আইনি সীমা) মধ্যে পড়ে না।

জানা গেছে, আইপিওতে ২৫২ টাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ওয়ালটনের শেয়ার পেয়েছেন। এরপর বুধবার বাজারে কোম্পানিটির প্রথম লেনদেন হয়।

নিয়ম অনুসারে প্রথম দিনে ৫০ শতাংশ দাম বাড়তে পারে। আর প্রথম ১ মিনিটের মধ্যেই ৫০ শতাংশ দাম বেড়েছে, যা সার্কিট ব্রেকার (সর্বোচ্চ সীমা) স্পর্শ করে। ফলে দিন শেষে কোম্পানিটির ৩০ কোটি ২ লাখ শেয়ারের মোট বাজারমূল্য দাঁড়ায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।

দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবারেও ৫০ শতাংশ দাম বেড়ে ২ মিনিটেই কোম্পানির শেয়ারের দাম সার্কিট ব্রেকার স্পর্শ করে। ফলে ১০ টাকার শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬৭ টাকা। এতে কোম্পানিটির বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে নিয়ম অনুসারে উদ্যোক্তারা ৩০ শতাংশ শেয়ার হাতে রেখে বাকি ৭০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলতে পারেন। সে হিসাবে বৃহস্পতিবারের দাম অনুসারে কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা ৮ হাজার ১৬ কোটি টাকা তুলতে পারেন।

এছাড়া ৩০২ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিতে বর্তমানে ব্যাংক ঋণ ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এরমধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ৯২০ কোটি এবং দীর্ঘমেয়াদি ৬২০ কোটি টাকা।

এর মানে হল, ঋণজনিত ঝুঁকিতে ওয়ালটন। হিসাব বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘ফাইন্যান্সিয়াল লিভারেজ’ বলে।

চরম মন্দা বাজারে অতিরিক্ত দামেই রহস্যজনক কারণে অনুমোদন পেয়েছে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের প্রাথমিক শেয়ার (আইপিও)। কোম্পানিটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার আইপিওতেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ২৫২ টাকায় কিনতে হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ও বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে অদৃশ্য কারণে অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি।

মার্চের শুরুতে ওয়ালটনের বিডিং শেষ হয়। এরপর তা অনুমোদনের জন্য বিএসইসিতে আবেদন করে কোম্পানিটি। পরবর্তী সময়ে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আর্থিক বিবরণী পূনর্মূল্যায়নের দাবি আসে। এরপর আইপিও প্রক্রিয়া থেমে যায়। গড়িয়ে যায় অনেক সময়। এরপর নতুন কমিশন এসে আইপিও অনুমোদন দেয়।

জানা গেছে, বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে কোম্পানির কাট অফ প্রাইস নির্ধারিত হয় ৩১৫ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক রিপোর্টকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখায় ওয়ালটন।

বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বেশি প্রিমিয়াম পেতে এক বছরেই ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আয় বৃদ্ধির অস্বাভাবিক তথ্য তুলে ধরা হয়। যেখানে আগের বছরের চেয়ে ২০১৮-১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ২৯১ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে কোম্পানিটির মোট ৫ হাজার ১৭৭ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। যার বড় অংশ বিক্রি দেখানো হয়েছে একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন প্লাজার কাছে।

এসব পণ্য বিক্রির বড় অংশই হয় বাকিতে। এ বাকিতে বিক্রির অর্থই মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আলোচ্য সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। আগের বছর যা ছিল ৩৫২ কোটি টাকা। অথচ পণ্য বিক্রি বৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মানে হল- পণ্য বিক্রি কম, কিন্তু মুনাফা অনেক বেশি। যা সাংঘর্ষিক ও অস্বাভাবিক।

কিন্তু এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কোম্পানিটির মুনাফা ৫২ শতাংশ এবং টার্নওভার ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছিল। অন্যদিকে ওয়ালটনের মুনাফা বাড়লেও একই বছরে ক্যাশ ফ্লো ১০২ কোটি টাকা কমেছে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা কোম্পানিটির অডিট রিপোর্ট পুনর্নিরীক্ষার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তা আমলে নেয়নি বিএসইসি। নিয়ম অনুসারে কাট অফ প্রাইস নির্ধারণের পর বিএসইসির হাতে দুটি অপশন থাকে।

আইন অনুসারে এ শেয়ারের দাম বিএসইসি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য দাম ১০ শতাংশ কমাতে পারে। অথবা বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অর্ডিন্যান্সের ২ সিসি ধারার ক্ষমতাবলে বিডিং বাতিল করতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই কারণে ওয়ালটনের বিডিং বাতিল করতে পারত কমিশন। প্রথমত, কোম্পানিটির আর্থিক রিপোর্টে সমস্যা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, করোনার কারণে পুরো বাজার তলানিতে চলে এসেছিল। ফলে আগের নির্ধারিত দামে এখন আইপিও অনুমোদন অযৌক্তিক ছিল।

বাজারসংশ্লিষ্টরা জানান, বাজারে কারসাজির বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ওয়ালটন। কারণ কোম্পানিটি বাজারে মাত্র ১ শতাংশের কম শেয়ার ছেড়েছে। এতে কয়েকজন বিনিয়োগকারী যোগসাজশ করে শেয়ার কিনে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারেন।

আইপিও অনুমোদনের ফলে বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে ২৯ লাখ ২৮ হাজার ৩৪৩টি সাধারণ শেয়ার প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে ইস্যু করেছে ওয়ালটন। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬৭টি সাধারণ শেয়ার যোগ্য বিনিয়োগকারীরা কিনেছেন।

যোগ্য বিনিয়োগকারীদের বিডিংয়ে তাদের প্রস্তাব করা দামে শেয়ার কিনতে হয়েছে। বাকি ১৫ লাখ ৪৮ হাজার ৯৭৬টি সাধারণ শেয়ার ২৫২ টাকা মূল্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীর (অনিবাসী বাংলাদেশিসহ) কাছে ইস্যু করা হয়েছে।

পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য ৭ জানুয়ারি বিএসইসি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে বিডিংয়ে অংশ নেয়ার অনুমোদন দেয়। এ অনুমোদনের ফলে কাট অফ প্রাইস নির্ধারণে ২ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত যোগ্য বিনিয়োগকারীরা বিডিংয়ে অংশ নেয়। এ সময়ের মধ্যে বিডিংয়ে অংশ নেন ২৩৩ জন।

এসব বিনিয়োগকারী সর্বনিু ১২ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৭৬৫ টাকা করে ওয়ালটনের শেয়ার কেনার জন্য প্রস্তাব দেন। তবে ৭৬৫ টাকা প্রস্তাব করেছে ইসলামী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি যুগান্তরকে জানায়, তারা ভুলবশত সেটি করেছে। পরে ভুল সংশোধনের জন্য বিএসইসিতে আবেদনও করেছিল। কিন্তু তা আমলে নেয়া হয়নি। অন্যদিকে ওয়ালটনের প্রতিটি শেয়ারের জন্য ২১০ টাকা দাম প্রস্তাব করেন সব থেকে বেশি সংখ্যক যোগ্য বিনিয়োগকারী। এ দামে ১৪ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক বিনিয়োগকারী দাম প্রস্তাব করেন ১৫০ টাকা করে। এ দামে ১০ জন বিনিয়োগকারী কোম্পানিটির শেয়ার কেনার আগ্রহ দেখান। তবে বিডিংয়ে বরাদ্দ করা ৬০ কোটি ৯৬ লাখ টাকার শেয়ারের জন্য ৩১৫ টাকার উপরে বিডিং হয়।

২০১৯ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির পুনর্মূল্যায়ন সঞ্চিতিসহ শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ মূল্য ২৪৩ টাকা ১৬ পয়সা এবং পুনর্মূল্যায়ন সঞ্চিতি ছাড়া নিট সম্পদ মূল্য ১৩৮ টাকা ৫৩ পয়সা। আর বিগত ৫টি অর্থবছরের ভারিত গড় হারে শেয়ার প্রতি আয় ২৮ টাকা ৪২ পয়সা।

এ ব্যাপারে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, আসলে বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের দাম কত হবে, এটি যোগ্য বিনিয়োগকারীরা নির্ধারণ করেন। এখানে কমিশনের কোনো হাত নেই।

দ্বিতীয়ত, যে পরিমাণ শেয়ার ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, তাও আইনি সীমার ব্যত্যয় হয়নি। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দামের পরেও আমরা ১০ শতাংশ কমিয়েছি।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। আলামিন নামের এক বিনিয়োগকারী লেখেন, বিনিয়োগকারীদের মরণফাঁদ হতে যাচ্ছে ওয়ালটন। মুজিবুর রহমান নামের একজন বিনিয়োগকারী লিখেছেন- এমনিতেই উচ্চমূল্য ওয়ালটনের শেয়ারের।

এরপরও ১ শতাংশের নিচে শেয়ার বাজারে আসায় শুরুতে উচ্ছ্বাস ও রমরমা লেনদেনের সুনিপুণ ব্যবস্থা করছে বাজার-কারিগর সিন্ডিকেট। আগামীতে কোম্পানিটির মেকআপবিহীন আসল চেহারার সাক্ষাৎ মিলবে। ততক্ষণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শোকাহত অবস্থা হবে।

যুগান্তর থেকে নেওয়া

Facebook
Twitter
LinkedIn