প্রশাসন নিরব ? আঞ্জুমান মফিদুলের জনৈক এম্বুলেন্স ড্রাইভার বাশার। চাকরি ছেড়ে অপেক্ষায় আছে সামনের ১ তারিখ সে সৌদি আরব যাবে। তার দুটি সন্তান। তাদের ভালো ভবিষ্যতের আশায়। এতদিন মহামারী করোনার কারণে তার প্রবাস জীবনের স্বপ্নের বিলম্ব হচ্ছিল। তার এক নিকট আত্মীয়ের মাধ্যমে বহু চেষ্টা তদবির আর জমানো যোগানো সর্বস্ব দিয়ে একটা ভিসা যোগার করলেও নীল আকাশে উড়ালের যে দিন কয়েক বাকী এয়ার টিকেট কিনতে এসে তা যেন এখন মরার ওপর খড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে !
সাধারণ এই লোকটির জন্য যা এক প্রকার আচানক অর্থনৈতিক নির্যাতন !
শুধু এই ড্রাইভার বাশার নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভিসা হাতে নেয়া প্রত্যেকটি যাত্রীর জন্য বিষয়টা এখন চরম ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহামারী কাটিয়ে যখন বাইরে যাওয়ার জন্য বিশ্বের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হচ্ছে ঠিক তখনই বিদেশ গমনিচ্ছুদের জন্য বিমান টিকের ভাড়ার পায়তাড়াটি শুরু হয়। মাসখানিক পূর্বে টিকেটের দাম যা ছিল তা থেকে বিমান টিকিটের দাম এখন হঠাৎ হয়ে গেল আকাশ ছোঁয়া! পূর্বের দাম থেকে প্রতিটি টিকেটের দাম ৫০% – ৬০% বেড়ে গেল হুড়হুড় করে । এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ এখানে টিকেটের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করছে। অথচ যেসব ফ্লাইটে লোক যাচ্ছে, তাদের ভাষ্যমতে প্রতি ফ্লাইটে কমপক্ষে ৩০% সিট খালি রেখে আকাশে বিমান নাকি উড়ছে ? তাহলে টিকিটের দাম বৃদ্ধির বা সিট স্বল্পতা দেখানোর মূল কারণ বা রহস্য কী ?
গোপনসূত্রে জানা যায়, বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এয়ারলাইন্সের সাথে যাদের সংশ্লিষ্টতা তারাই ছোলা আলু পেয়াজের ব্যবসার মত কমমূলে বিমানের টিকেট মজুদ রাখছে। এবং তা ৫০%-৬০% বর্ধিত হারে টিকেট ইস্যু করছে। অথচ অবাক হওয়ার বিষয়, আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আরব আমিরাত যেতে একটি টিকেটের বিপরীত মূল্য ৪০-৫০ হাজার টাকাতেই ওই দেশের যাত্রীরা যেতে পারছে। আর আমাদের দেশে দুবাইয়ের বিমান ভাড়া নেয়া হচ্ছে ১ লাখ টাকা থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ? মজার বিষয়, এই দেশে, এই টিকিটের দাম কিন্তু ছিল কয়দিন আগে, মাত্র ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা ?
এই কয়দিনের অনলাইন সংবাদ সূত্র থেকে সবাই অবগত যে, ৩০-৪০ হাজার টাকার মধ্যে যেসব টিকিটের দাম ওঠানামা করত, তা এখন ৯০ থেকে ১ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। টিকেট কিনতে ট্রাভেল এজেন্সীগুলো গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সদ্য বিদেশযাত্রীরা। রিয়াদ, দুবাই, আবুধাবি, দাম্মাম, দোহা, মাস্কাটসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব রুটেই টিকিটের দাম আগের চেয়ে এখন দ্বিগুন। অনেকেই এই বিষয়কে কোভিটকে পুঁজি করে ফালতু কারণ উপস্থাপন করছে বলেও টিকিট ক্রয়ে আসা বিদেশ যাত্রীদের অভিমত।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার কথা বলে সবাইকে আস্বস্থ করলেও বিষয়টির আশু ফলাফল এখনও যাত্রীরা ভোগ করতে পারছে না। কোভিড ও লকডাউনের কারণকে ভাঙা যুক্তি হিসেবে দাঁড় করালেও মানুষ এখন সচেতন। সবাই বুঝতে পারছে আশেপাশের ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান কোথাও এমনটি ঘটছে না?
অনেকে এই মুহূর্তে এই সংকট নিরসনে বাড়তি বিমানের ব্যবস্থা করে বিদেশযাত্রীদের টিকিটের বর্ধিতমূল্য নিরসনের পরামর্শ দিয়েছেন। আর বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্সীর মালিকেদের সংগঠন আটাব এই সংকট মোকাবিলার কোন পরামর্শ না দিয়ে নিজেরাও ক্ষোভ জানিয়েছে এভাবে – ‘‘ টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি এক ধরনের কারসাজি ’’
এটা যেন বøাকে সিনেমা হলের বা ক্রিকেট খেলার বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার কোন ক্রিকেট খেলার টিকেট কিংবা ঈদের সময় ব্লাকারদের টিকেট মজুদ রেখে টিকেট নাই নাই সুর তুলে ডাবল কিংবা চার ডাবল দামে টিকেট হাঁকানোর মত ইমেজে পরিণত হয়েছে।
ঘটনা যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার ভাড়ায় ঘটেছে তা কিন্তু নয়। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার ফ্লাইটগুলোতেও এই একই সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিদেশযাত্রীরাই যদি দেশের প্রাণ হয় তাহলে এরা দেশের মানুষের কাছেই কেন বা প্রতিটি ক্ষেত্রে জিম্মি হয়ে থাকবে ? কোভিডের পর থেকেই দেশে এয়ার টিকিটের ভাড়া বেশি নেয়ার প্রবণতার কালচার শুরু হয়েছে। কোভিড টেস্টেও জন্যও প্রতিটি যাত্রী দিচ্ছে বাড়তি টাকা। নানান অভিবাসন ব্যয়ের কারণ বাড়তে থাকলে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রমিক যাওয়ার হার যে কমতে শুরু করবে এটা নিশ্চিত। আর যার প্রতিক্রিয়া পড়বে আমাদের সামগ্রিত অর্থনৈতিক খাতে।
বাংলাদেশের রেমিটেন্স যোদ্ধাদের স্বপ্নের বিদেশ যাত্রা যদি এভাবে হঠাৎ করে প্রশ্নাতীত ও হুমকীর মুখে পড়ে। তাহলে সেটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও কিন্তু নিঃসন্দেহে বাধাগ্রস্ত করবে। আর বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের বাংলাদেশের শ্রমবাজার চলে যাবে শোচনীয় অবস্থার তলানীতে। প্রবাসে আমাদের যে এক কোটি শ্রমিক রয়েছে, যারা বিশ্ববাজারে কাজ করছে। এদের ৭০-৭৫ লাখই কাজ করছে আরববিশ্বে। এমনকি ওমরা ভিসায়ও হরদম যেতে টিকিটের বর্ধিত হারে কোনঠাসা হচ্ছেন প্রতিদিন দেশের অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করছে এখন বিষয়টির সমাধান। কেননা, দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির মূল অংশই কিন্তু সচল রাখছেন – আমাদের প্রবাসী ও বিদেশগমনিচ্ছু যাত্রীরা।
মারুফ আহমেদ
বিশেষ প্রতিনিধি