দেশে করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে! বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তারের মধ্যে দেশে ১০৮ দিন পর দৈনিক নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত কোভিড রোগীর হার আবার ৫ শতাংশের উপরে উঠে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এলে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ধরা হয়। আর সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ ছাড়ালে পরবর্তী ঢেউ আঘাত হেনেছে ধরা হয়। দেশে সংক্রমণের হার গত ২১ সেপ্টেম্বরের পর প্রথমবার এই ধাপ ছাড়ালো।
করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টকে মৃদ করে দেখা সুযোগ নেই বলে সতর্ক করে দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেড্রোস আধানম গেব্রেইসাস। তিনি বলেন, রেকর্ড সংখ্যক মানুষ সম্প্রতি এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বড় ধরণের চাপের মুখে ফেলেছে।
করোনা ভাইরাসের টিকা না নিয়ে কেউ ঘরের বাইরে বের হলে তাকে গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতের্তে।
বাংলাদেশেও এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, করোনা সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের উপরে গেলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দেশে বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি তৃতীয় ঢেউয়ে রূপ নিচ্ছে।
দেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আছে। দুটো মিলে হয় ডেলমিক্রন। যা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তাই এখনই স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু আদেশ কিংবা নির্দেশনা দিলে হবে না, বাস্তবায়ন করতে হবে। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ডিসি-এসপিরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে তাদেরও বিপদ আছে। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট আগের চেয়ে ৭০ ভাগ বেশি শক্তিশালী। তাই দেশে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার মানুষ পাওয়া যাবে না। শুধুমাত্র মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে পারলে ৯০ ভাগ নিরাপদ থাকা যায়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরে না, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না। এদিকে গ্রাম পর্যায়ে করোনার টিকা যথাযথভাবে দেওয়া হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং করা হচ্ছে না। অনেকে টাকা না দিলে টিকা দিচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিদিন প্রায় ৭টি সীমান্ত দিয়ে দুই সহস্রাধিক পণ্যবাহী ট্রাক ভারত থেকে আসা যাওয়া করছে। ট্রাক চালকসহ দুই জন লোক থাকে। তাদের কোন পরীক্ষা করা হয় না। এমনকি সীমান্তবর্তী এলাকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ইত্তেফাকের স্থানীয় প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন যে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য কোন ধরনের নির্দেশনা আমরা গতকাল পর্যন্ত পাইনি। যেহেতু ভারতে ডেল্টার পাশাপাশি ওমিক্রনের ভয়াবহ অবস্থা, সেখানে অবাধে এই যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশে ব্যাপক হারে সংক্রমণ শুরু হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন। প্রশাসনের ঢিলাঢালাভাব সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিপদের দিকে ফেলে দিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, দেশে যেভাবে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে সবার সচেতন হতে হবে। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, টিকা নিতে হবে। সীমান্তসহ সকল বন্দরে করোনার র্যাপিড টেস্ট চালু করতে হবে। যাতে তাৎক্ষণিক রিপোর্ট পাওয়া যায়। আর স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শুধু আদেশ বা নির্দেশনা দিলে হবে না। এটা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে ওয়ার্ড পর্যায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমামসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য কমিটি গঠন করার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, যেহেতু সংক্রমণ বাড়ছে, তাই আজ থেকে করোনার পরীক্ষাও বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, সংক্রমণ ৫ শতাংশের উপরে গেলে সাধারণত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার স্বার্থে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলে সবার মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে জেল-জরিমানা দিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের উপরে গেলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ দেশে করোনা সংক্রমণ তৃতীয় ঢেউয়ে রূপ নিচ্ছে। যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি শুধু আদেশ দিয়ে বসে থাকলে হবে না, বাস্তবায়ন করতে হবে। আইন প্রয়োগ করার মাধ্যমে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। কড়াকড়িভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা না গেলে সামনে বিপদ অপেক্ষা করছে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব শতভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। অনেক বৃদ্ধরা টিকা নেননি। তাদের অবশ্যই টিকা দিতে হবে। সব বয়সীদের দ্রুত টিকা দিতে হবে। একই সঙ্গে উপজেলা হাসপাতালে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যাতে সেখান থেকে করোনা রোগীরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে পারেন।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, সংক্রমণ শনাক্তের হার ৫ শতাংশের উপরে গেলেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে ধরা হয়। তবে এই মুহূর্তে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ বলার পরিপূর্ণ অবস্থা আসেনি।
তিনি বলেন, সবার মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। একই সঙ্গে করোনার টিকা নিতে হবে। দেশের সকল ইপিআর টিকাদান কেন্দ্রে ব্যাপক ভিত্তিতে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। গ্রামের মানুষ সেখান থেকেই টিকা নিতে পারেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ১৪৬ জনের কোভিড শনাক্ত হয়েছে। তাতে নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এর আগে সর্বশেষ শনাক্তের হার পাঁচের উপরে ছিল ২০ সেপ্টেম্বর। সেদিন শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। করেননা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময় গতবছর জুলাই-আগস্ট সময়ে দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর তা নামতে নামতে জুলাই মাসে ২ শতাংশের নিচে চলে আসে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু এরমধ্যেই বিশ্বে শুরু হয় ওমিক্রনের ত্রাস।
৩ জানুয়ারি দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ এবং ৫ জানুয়ারি তা ৪ শতাংশ ছাড়ায়। দুই দিনের মাথায় তার ছাড়িয়ে গেল পাঁচ শতাংশের ঘর। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৯১ হাজার ৯৩ জনে। গত এক দিনে আরও একজন কোভিড রোগীর মৃত্যু হওয়ায় সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৯৮ জনের মৃত্যু হল এ ভাইরাসে।
সরকারি হিসাবে গত এক দিনে দেশে করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ১৭০ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৩৪ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন। গত একদিনে শনাক্তদের মধ্যে কেবল ঢাকা মহানগরসহ ঢাকা জেলাতেই শনাক্ত হয়েছেন ৯০২ জন। অর্থাৎ শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে ৭৮ দশমিক ৭১ শতাংশই ঢাকা জেলার।