বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দেশে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনই নতুন রোগী ও শনাক্তের হার বাড়ছে। নতুন করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় দেশে এক দিনে শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৪৫৮ জন; দৈনিক শনাক্তের হার পৌঁছেছে ৯ শতাংশের কাছাকাছি।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বাড়লে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে জ্যামিতিক হারে বাড়ার কারণে দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবা কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। ঐ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন হুমকির সম্মুখীন। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটি নির্ভর করছে, আগামীকাল সরকারের ১১ দফা বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ওপর। মোবাইল কোর্ট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিকভাবে বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, দোকানপাটের মালিক সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সচেতন হতে হবে। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করা গেলে ৯০ ভাগ নিরাপদ থাকা যায়। রেস্টুরেন্টে টিকার সার্টিফিকেটের পাশাপাশি মাস্ক পরার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের ১১ দফা বিধিনিষেধ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নইলে করোনা জ্যামিতিক হারে বেড়ে দেশে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে বলেও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনা মোকাবিলায় সরকার যে ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ এই বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে দেশে করোনা পরিস্থিতি কোনো দিকে মোড় নেবে। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে প্রশাসনকে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে হবে। দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, গণপরিবহন সবত্রই মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সারা দেশে পাড়া-মহল্লায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন করতে হবে, যে কমিটি স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনগণকে সচেতন করে তুলবে।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বাড়লে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। পরিস্থিতি বিপজ্জনক দিকে নিয়ে যাবে। আর যদি স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রেক্ষিতে দেশে করোনা আস্তে আস্তে বাড়ে, তাহলে তা ঠেকানো সম্ভব হবে। টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, টিকা নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের ১১ দফা বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করতে হবে। আগামীকাল থেকে বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে দেশে করোনা বাড়বে নাকি কমবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। আমরা এখন তাকিয়ে আছি আগামীকাল বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের দিকে। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বাড়বে নাকি আস্তে আস্তে বাড়বে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে দেশ উপকৃত হবে, অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরো ২ হাজার ৪৫৮ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃত্যু হয়েছে দুই জনের। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর একদিনে এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল, সেদিন ২ হাজার ৫৮৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। গত এক দিনে দেশে মোট ২৭ হাজার ৩৯৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তাতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এর আগে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার এর চেয়ে বেশি ছিল। সেদিন প্রতি ১০০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৯ দশমিক ০৭ জনের কোভিড পজিটিভ এসেছিল। সোমবার ২ হাজার ২৩১ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। করোনা ভাইরাসের ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময় গত বছর জুলাই-আগস্ট সময়ে দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর তা নামতে নামতে জুলাই মাসে ২ শতাংশের নিচে চলে আসে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই বিশ্বে শুরু হয় ওমিক্রনের ত্রাস।
৩ জানুয়ারি দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ এবং ৬ জানুয়ারি তা ৫ শতাংশ ছাড়ায়। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩৮৯ জনে। গত এক দিনে আরো দুজনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ১০৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। সরকারি হিসাবে গত এক দিনে দেশে করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ২৭৪ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৭ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন। এই হিসাবে দেশে এখন সক্রিয় কোভিড রোগীর সংখ্যা ১৮ হাজার ৮৯৫ জন, যা আগের দিন ১৬ হাজার ৭১৩ ছিল। গত এক দিনে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ১৯৭৯ জনই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা, যা মোট আক্রান্তের ৮০ শতাংশের বেশি। দেশের ১৩টি জেলায় এক দিনে কারো করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। যে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তারা সবাই পুরুষ। তাদের বয়স ছিল ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম বিভাগের এবং একজন খুলনা বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। গত এক দিনে পরীক্ষা করা ২৭ হাজার ৩৯৯টি নমুনা মিলিয়ে এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৭টি নমুনা। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।