গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসের চারদিনই পতন হয়েছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)। ফলে সাপ্তাহিক লেনদেনে ডিএসইর সব সূচক, লেনদেন ও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর কমেছে। এ ছাড়া আলোচিত সপ্তাহে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি।
গত সপ্তাহে ডিএসইতে ছয় হাজার ১৪৯ কোটি ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ৯২০ টাকার লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে এটি ছিল আট হাজার ২৪৩ কোটি ১৯ লাখ ২৫ হাজার ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ লেনদেন কমেছে দুই হাজার ৯৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৭ হাজার ২১৫ টাকা বা ২৫ শতাংশ।
লেনদেনের চিত্র বিশ্লেষণ ও পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহজুড়ে শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রয়ের দিকে ঝুঁকতে দেখা গেছে বিনিয়োগকারীদের। প্রচণ্ড বিক্রয় চাপ-ই পতন এনেছে পুঁজিবাজারে। এই বিক্রয় চাপ ত্বরান্বিত করেছে তিনটি বিষয়।
প্রথমত, কভিড-১৯-এর সংক্রমণ বেড়েছে। ফলে কভিডের তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়লে পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎ কোন দিকে ধাবিত হবে, সেটা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে নতুন করে বিনিয়োগ নিয়ে ভাবছেন তারা।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন কোম্পানি দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করেছে। গত বছর জুনে যেসব কোম্পানির অর্থবছর শেষ হয়েছে সেসব কোম্পানি দ্বিতীয় আর ডিসেম্বর ক্লোজিংয়ের কোম্পানিগুলো চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ ঘোষণার সিদ্ধান্ত জানাবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক চিত্র উঠে আসে এসব প্রান্তিক প্রতিবেদনে। এর ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নেন, কোন কোম্পানিতে নতুন বিনিয়োগ করবেন আর কোনটাতে করবেন না। এতে নতুন বিনিয়োগে যেতে সময় নিচ্ছেন তারা।
তৃতীয়ত, বছরের শুরু থেকে শেয়ারের দরবৃদ্ধির মাধ্যমে ইতিবাচক ধারায় লেনদেন হয়েছে পুঁজিবাজারে। এই সময়ের মধ্যে যারা মুনাফা করতে পেরেছেন তারা মুনাফা গ্রহণ করছেন। এই মুনাফা গ্রহণ বা দর সংশোধনের কারণে বিক্রয় চাপ বেড়েছে।
আলোচিত এ তিন ইস্যুতে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থানে চলে গেছেন। সপ্তাহজুড়ে শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রির মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ করেছেন তারা, যার কারণে বাজার নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে।
এ বিষয়ে ব্রোকারেজ হাউস এক্সপো ট্রেডার্সের এক শীর্ষ কর্মকতা বলেন, এখন কোম্পানিগুলো তাদের বিভিন্ন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। কোম্পানিগুলোর ভালো-মন্দ দিক সামনে আসতে থাকবে, যা বিনিয়োগে প্রভাব ফেলে। এ সময় বাজারের ওঠানামা স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা যায়। অতীতেও এমনটা দেখা গেছে।
লেনদেনের তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহজুড়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের শীর্ষে ছিল বিবিধ খাত। মোট লেনদেনের ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল এই খাতের। ১২ দশমিক ৪ শতাংশ লেনদেন করে দ্বিতীয় বস্ত্র ও ১১ দশমিক ২ শতাংশ লেনদেন করে ওষুধ ও রসায়ন তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
এ ছাড়া সপ্তাহজুড়ে প্রকৌশল খাতে ৮ দশমিক ৫, খাদ্য খাতে ৮ দশমিক ৪, জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে ৭ দশমিক ৭, সাধারণ বিমা খাতে ৬ দশমিক ২, ব্যাংক খাতে ৪ দশমিক ৪, ট্যানারি খাতে ৪ দশমিক ২, জীবন বিমা খাতে ৩ দশমিক ৮, আর্থিক খাতে ৩ দশমিক ১, সিরামিক খাতে ২ দশমিক ৭, সেবা-আবাসন ও কাগজ খাতে ২ দশমিক ৬, আইটি খাতে ২ দশমিক ৪, টেলিযোগাযোগ খাতে ১ দশমিক ৭, সিমেন্ট খাতে ১ দশমিক ৩, ট্রাভেল খাতে শূন্য দশমিক ৮, মিউচুয়াল ফান্ড খাতে শূন্য দশমিক ৫ ও পাট খাতে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ লেনদেন হয়েছে।
ডিএসইর তথ্যমতে, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৪ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ১১ টাকা। শেষ কার্যদিবসে বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৫ লাখ ৬২ হাজার ৯০২ কোটি ৯৬ লাখ ১৪ হাজার ১৩৪ টাকায়। বাজার মূলধন বাড়া বা কমার অর্থ হলো লেনদেন হওয়া সিকিউরিটিজের দর ওই পরিমাণ কমেছে বা বেড়েছে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে বা কমেছে। ফলে আলোচিত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীরা দুই হাজার ৩৩২ কোটি ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮৭৭ টাকা হারিয়েছেন।
এদিকে গত সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭৮ দশমিক ১৪ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ১০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ২৭ দশমিক ৫৫ পয়েন্টে। সপ্তাহের শুরুর দিন রোববার সূচক কমেছিল ৩২ দশমিক ৬৯ পয়েন্ট। সোমবার কমেছে ৫৩ দশমিক ৭৫ পয়েন্ট। পরের দিন মঙ্গলবার সূচক বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩২ পয়েন্ট। বুধবার শূন্য দশমিক ১৩ পয়েন্ট ও শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার সূচক হ্রাস পেয়েছে ৪ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট।
অন্য সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ৮ দশমিক ৪২ পয়েন্ট বা শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ ও ব্ল–-চিপ বা ডিএস৩০ সূচক ৩৩ দশমিক ০৪ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৪৯৯ দশমিক ৯৭ পয়েন্টে এবং দুই হাজার ৬০২ দশমিক ৩৪ পয়েন্টে।
বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে মোট তিন হাজার ৮৮৮টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ৯৯টির বা ২৫ দশমিক ২৬ শতাংশের, কমেছে ২৬৮টির বা ৬৯ দশমিক ০৭ শতাংশের ও অপরিবর্তিত ছিল ২১টির বা ৫ দশমিক ৪১ শতাংশের।
লেনদেনকৃত সিকিউরিটিজের দরপতনের কারণে সাপ্তাহিক রিটার্নে দর কমেছে ১৪ খাতে। বিপরীতে বেড়েছে মাত্র ৬ খাতে। সবচেয়ে বেশি দর কমেছে বিবিধ খাতে। এ খাতে ৩ দশমিক ২ শতাংশ দর কমেছে। আর ভ্রমণ-অবকাশ খাতে ৩ শতাংশ দর কমে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। সেবা-আবাসন খাতে ২ দশমিক ৭ শতাংশ দর কমে তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
অন্য খাতগুলোর মধ্যে পাট খাতে ২ দশমিক ৬, সিমেন্ট খাতে ১ দশমিক ৮, প্রকৌশল খাতে ১ দশমিক ৭, টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি-বিদ্যুৎ ও জীবন বিমা খাতে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করে দর কমেছে। মিউচুয়াল ফান্ড খাতে ১ দশমিক ৫, আইটি খাতে ১ দশমিক ৩, ফার্মা খাতে শূন্য দশমিক ৫, ব্যাংক খাতে শূন্য দশমিক ৪ ও কাগজ খাতে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ দর কমেছে। অন্যদিকে দর বেড়েছে আর্থিক, সিরামিক, খাদ্য, ট্যানারি, সাধারণ বিমা ও বস্ত্র খাতে।