ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিরিয়েছেন দলকে, গড়েছেন রেকর্ড জুটি। সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের আগের রেকর্ড (১২৭) টপকে নতুন রেকর্ড (১৭৪) গড়লেন আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ। তাদের ব্যাটে চেপে জয়ের হাসি হাসল টাইগাররা। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আফগানিস্তানের দেওয়া ২১৬ রানের টার্গেট টপকে ৪ উইকেটের জয় পেয়েছে বাংলাদেশ।
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে এসে আলোচিত হয়েছিলেন মিরাজ। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ান তিনি। সেই চট্টগ্রামেই আবার আলোচনায় মিরাজ। আফিফের সঙ্গে রেকর্ড জুটি বেঁধে বাংলাদেশকে এনে দিলেন দারুণ এক জয়। আফিফ-মিরাজের যুগলবন্দীতে শুরুতেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশ আফগানদের বিপক্ষে অসাধারণ জয় তুলে নিল।
তবে এর আগের গল্পটা ছিল ভয়ঙ্কর। রান তাড়ায় উদ্বোধনী জুটিতে ব্যাটিংয়ে আসেন তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। প্রথম ওভারে দুটি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দারুণ শুরুর ইঙ্গিত দেন তামিম। কিন্তু এরপরই হঠাৎ এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড বাংলাদেশের ব্যাটিং। সেই ধ্বংসযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন বিপিএলে ঢাকার হয়ে খেলা ফজলে হক ফারুকি। ইনিংসের তৃতীয় এবং নিজের দ্বিতীয় ওভারেই এই পেসার জোড়া শিকারে ফেরান লিটন আর তামিমকে। ফারুকির মিডল স্টাম্পে থাকা বল ডিফেন্স করতে চেয়েছিলেন লিটন। ঠিক মতো পারেননি। ব্যাটের কানা ছুঁয়ে জমা পড়ে উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে। লিটন ফেরেন ৮ বলে ১ রানে।
এক বল পর পা বাড়িয়ে খেলতে চেয়েছিলেন তামিম। ব্যাটে-বলে করতে পারেননি বাঁহাতি এই ওপেনার। লিটনের পর তামিমের বিপক্ষে রিভিউ নিয়েও সফল আফগানরা। দুই চারে ৮ বলে ৮ রান করে বিদায় নেন তামিম। চারে আসা মুশফিকুর রহিমকে নিজের তৃতীয় শিকার বানান ফারুকি। ইনিংসের পঞ্চম ওভারে আবার জোড়া আঘাত ফারুকির। এবার তার গতির কাছে পরাস্ত মুশফিকুর রহিম ও অভিষিক্ত ইয়াসির আলি রাব্বি।
বাঁহাতি পেসারের মিডল স্টাম্পে পড়ে প্রায় সোজা যাওয়া বলের লাইনে যেতে পারেননি মুশফিক। আরেকটু বেশি সুইং আশা করা ‘মিস্টার ডিপেন্ডডেবল’ এলবিডব্লিউ হওয়ার পর নেন রিভিউ। কাজ হয়নি, রিপ্লেতে দেখা গেছে বল লাগতো অফ-মিডল স্টাম্পে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর নিজের প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমে ফারুকির বলের লাইন মিস করে বোল্ড হয়ে শূন্য রানে সাজঘরে রাব্বি। ১৮ রানে নেই বাংলাদেশের ৪ উইকেট।
অষ্টম ওভারে বোলিংয়ে এসে সাকিব আল হাসানকে ফেরান তার বিপিএল সতীর্থ মুজিব উর রহমান। অফ স্টাম্পের বাইরের বল ব্যাটের কানায় লেগে স্টাম্পে আঘাত হানলে সাকিব আউট হন ১৫ বলে ১০ রানে। সতীর্থের পথে পা বাড়িয়ে সাজঘরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। রশিদ খানের শর্ট বল জায়গায় দাঁড়িয়ে কাট করার চেষ্টা করেন মাহমুদউল্লাহ। ঠিক মতো পারেননি তিনি। ক্যাচ যায় স্লিপে। এক চারে ১৭ বলে ৮ রান করেন অভিজ্ঞ এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। মাত্র ৪৫ রানে প্রথম সারির ৬ ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে বিপদ বাড়ে।
যখন নিজেদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন (৫৮) রানের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়, তখন থেকেই গল্পটা নিজেদের করে নেন মিরাজ আর আফিফে। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে দলকে ভেড়ান জয়ের নোঙরে। সেই ভীষণ চাপের সময় নেমে দুই তরুণ খেলছেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। দলকে লড়াইয়ে ফেরানোর পথে গড়েছেন সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি। ২০১৮ সালে মিরপুরে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের সঙ্গে ইমরুল কায়েসের ১২৭ ছিল সপ্তম উইকেটে আগের রেকর্ড জুটি।
দুজনের অবিচ্ছেদ্য ১৭৪ রানের জুটিতে ৪ উইকেট আর ৭ বল হাতে রেখে জয় পায় বাংলাদেশ দল। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম অর্ধশতকের স্বাদ পেয়েছেন আফিফ হোসেন। মিরাজ তুলে নিয়েছেন দ্বিতীয় অর্ধশতক। শেষ পর্যন্ত ১১৫ বলে ১১ চার ও ১ ছয়ে আফিফ অপরাজিত থাকেন ৯৩ রানে। ৯টি চারের সাহায্যে ১২০ বলে ৮১ রানে অপরাজিত থাকেন মিরাজ। এই জয়ের ফলে আইসিসি সুপার লিগে আরো ১০টি পয়েন্ট যোগ হলো অধিনায়ক তামিমের দলের পাশে।
এর আগে টস হেরে শুরুতে বোলিং করা বাংলাদেশ দলের বোলাররা স্বাগতিকদের সুবিধাজনক স্থানে রাখার কাজটা ঠিকঠাকই করেন। ইনিংসের তৃতীয় ওভারে আফগান ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজকে ফিরিয়ে দেন মুস্তাফিজ। তার বল উড়িয়ে বাউন্ডারির বাইরে ফেলতে চাইলেও তাতে ব্যর্থ হন গুরবাজ, মিডঅনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ১৪ বলে ১ চারে ৭ রানে। দলীয় ১১ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সফরকারী শিবির। ইব্রাহিম জাদরান আর রহমত শাহ দেখেশুনে খেলতে থাকেন। সে জুটি আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল ইব্রাহিম দুই বার সহজ জীবন পাওয়ায়।
এই পার্টনারশিপ ভেঙে স্বাগতিকদের ব্রেক থ্রু এনে দেন শরিফুল ইসলাম। বাঁহাতি পেসারের বেরিয়ে যাওয়া বলে ড্রাইভ করার চেষ্টায় স্লিপে ক্যাচ দেন ইব্রাহিম। ১৯ রানে সাজঘরে তিনি। ভাঙে ৬৫ বলে গড়া ৪৫ রানের জুটি। পরে এক প্রান্ত আগলে খেলে রান তুলছিলেন রহমত। হাঁটছিলেন অর্ধশতকের পথে। তাসকিনের ব্যাক অব লেন্থের বলে রহমতের ব্যাট ছুঁয়ে যায় মুশফিকের গ্লাভসে। ৬৯ বলে ৩ চারে ৩৪ রান করে সাজঘরে তিনি।
এক স্পেলে টানা ১০ ওভারে রান আটকে রাখেন মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রতিপক্ষের অফ স্পিনের দুর্বলতা বুঝতে পেরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক তামিম। ইনিংসের ২৮তম ওভারে নিজের একমাত্র ওভারে আফগান অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শাহিদিকে আউট করেন মাহমুদউল্লাহ। তার সোজা বলটি কাট করতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হন হাশমত। ৩ চার ও ১ ছয়ে তার ব্যাট থেকে আসে ৪৩ বলে ২৮ রান।
১০২ রানে ৪ উইকেট হারানো পর পঞ্চম উইকেটে নাজিবউল্লাহ জাদরান আর অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবী গড়েন ৬৩ রানের পার্টনারশিপ। তাদের এই জুটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালে বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনেন তামিম। মিরাজ, সাকিব, শরিফুল, মুস্তাফিজরা সফলতার দেখা পাচ্ছিলেন না। পরে তাসকিনকে আক্রমণে ফেরান তামিম। প্রতিপক্ষকে গতির আগুনে পুড়িয়ে অধিনায়কের আস্থার মান রাখেন এই পেসার। ইনিংসের ৩৯তম ওভারের ব্যাটের কানায় লেগে ক্যাচ যায় মুশফিকের গ্লাভসে। ২৪ বলে দুই চারে ২০ রান করেন নবী। ভাঙে ৬৩ বলে খেলা ৬৩ রানের জুটি।
এরপর নাজিবউল্লাহ একপ্রান্ত ধরে খেলে নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৩তম অর্ধশতক তুলে নেন। সাকিব ইনিংসের ৪৫তম ওভারে এসে জোড়া আঘাতে ফেরান গুলবাদিন নাইব আর পাকিস্তান সুপার লিগ মাতিয়ে আসা রাশিদ খানকে। সাকিবকে ফ্লিক করতে গিয়ে সাজঘরে গুলবাদিন। ২১ বলে ১৭ রান আসে তার ব্যাট থেকে। এর ২ পর রশিদ খান বুঝতেই পারেননি সাকিবের ফ্লাইটেড ডেলিভারি। নিমিষেই ভেঙে দেয় উইকেট। সাজঘরে ফেরেন ০ রানে।
আফগানদের শ্লথ হয়ে থাকা রানের গতি শেষদিকে ফেরান নাজিবউল্লাহ। দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ৮৪ বলে ৬৭ রান করেন। যেখানে ৪টি চার ও ২টি ছয় মেরে শরিফুলের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হন তিনি। মূলত নাজিবউল্লাহর ব্যাটে চেপেই নির্ধারিত শেষ ওভার অলআউট হওয়ার আগে স্কোর বোর্ডে ২১৫ রানের পুঁজি পায় আফিগানিস্তান। বাংলাদেশের হয়ে মুস্তাফিজ ৩টি এবং শরিফুল, সাকিব আর তাসকিন প্রত্যেকে ২টি করে উইকেট নেন।