ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে আগামী অন্তত তিন মাস মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রত্যাহার করার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসীম উদ্দিন। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই ভবনের সম্মেলন কক্ষে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন এবং আমদানিকারক প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এই প্রস্তাব দেন।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘ভোজ্যতেলের বাজার পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ভর্তুকি কিংবা কর সমন্বয় করতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে এ পর্যন্ত তিনবার কর সমন্বয় করে ভোজ্যতেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে এখনও একবারও হয়নি।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ এ নেতা জানান, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে সাক্ষাতে বিষয়টি তোলা হয়েছে। গত রোববার এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমি তাদের বলেছি, আপনি যখন বাজেটটা করলেন তখন বললেন, আপনি প্রতিকেজি ভোজ্যতেলে ১১ টাকা ভ্যাট পাবেন। কিন্তু এখন ৩০ বা ৩৩ টাকা পাচ্ছেন, এটা কেন? কভিড মহামারির কারণে পাল্টে যাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘শিপিং কস্ট বেড়ে গেছে। সাপ্লাই চেইন ভেঙে গেছে। সরকারের কাছে জোর দাবি জানাব যে, আগামী অন্তত তিন মাসের জন্য ভ্যাট প্রত্যাহার করা উচিত বলে আমি মনে করি।’
এ সময় ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতি, পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতি এবং আমদানিকারকদের নিজস্ব ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানিয়ে মজুতদার এবং বেশি দামে তেল বিক্রি করাসহ নিয়ম লঙ্ঘনকারী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন তিনি। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) পক্ষ থেকেও বাজার পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান শীর্ষ এই ব্যবসায়ী নেতা। সম্প্রতি বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন খুচরা বিক্রেতারা।
ক্রেতারাও বলছেন, বাজারে তেলের সরবরাহ কম এবং দামও অনেক বেশি। বিশ্ববাজারের ঊর্ধ্বগতির কারণ দেখিয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা করে বাড়ানোর ২০ দিনের মাথায় আবারও ১২ টাকা করে বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।
মিল মালিকদের এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে সেসময় বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, রমজান মাস সামনে রেখে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেটা মানতে হবে। তেলের সংকটে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও হুশিয়ারি দেন তিনি।
গত কয়েক মাসে ভোজ্যতেল আমদানির তথ্য তুলে ধরে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘এক মাস বা দুই মাস আগে এক হাজার, এক হাজার ২০০ বা এক হাজার ৩০০ ডলার করে যারা আমদানি করেছেন, তাদের কাছে তেল জমা আছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে এক হাজার ৮০০ ডলার হয়ে গেছে। যাদের কাছে আগের কম দামে কেনা তেল জমা আছে, তারা আজকের আন্তর্জাতিক বাজারের দামে বিক্রি করতে চাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘সামনে রমজান মাস। ব্যবসায়ীরা এমন করলে মানুষ কষ্টে পড়ে যাবে। মানুষকে সহযোগিতা করুন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে উৎসব এলে পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়, কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো।’ এ সময় ব্যবসায়ীদের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে জসীম উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব সরকার বলে ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য ভোজ্যতেল আমদানির সুযোগ দিয়েছে। অথচ আগে এটা সরকারের কাছে থাকত। বন্ডের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের দেয়া হতো। তখন স্টকটা সরকারের কাছেই থাকত, যার যত দরকার দিত। আপনারা সরকার এবং দেশের মানুষকে সহযোগিতা না করলে আমি সরকারকে আবারও তেলের স্টক সরকারের কাছে রাখার পরামর্শ দেব।’
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। ২০২১ সালে ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। সে হিসেবে তেলের মজুত ও সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। সভায় মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র এজিএম তাসলিম শাহরিয়ার দাবি করেন, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে ৬১ শতাংশ। একই সময়ে দেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ২১ শতাংশ। তবে এই তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এফবিসিসিআই সভাপতি জসীম উদ্দিন উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘বিশ্ববাজারের আজকের রেট হিসাব করে আপনি গড় করছেন। অথচ আজকের বিশ্ববাজারের তেল তো আপনার কাছে নেই। সরকার ও দেশের মানুষের সঙ্গে অন্যায় করবেন না,’ বলেন জসীম উদ্দিন।
সভায় বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা আমদানিকারক ও মিলারদের অব্যবস্থাপনা এবং পাইকারি বিক্রেতাদের সময়মতো তেল না দেয়ার কারণে দামে প্রভাব ফেলছে বলে জানান। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বা মিলগেটে গিয়ে টাকা দিয়ে তেল পাওয়া যায় না। তেল আনতে যে ট্রাক পাঠানো হয়, তেল না পাওয়ায় সেই ট্রাক পাঁচ দিন পর্যন্ত বসিয়ে রাখতে হয়। এই পাঁচ দিনের বসা ট্রাক ভাড়া আমাদের দিতে হয়। এর ফলে আমাদের ওই ভাড়া তেলের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। এর ফলে তেলের দাম বেড়ে যায়। ব্যবসায়ী এই নেতা বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো আচরণ করছে। অভিযানের নামে অন্যায্যভাবে চাপাচাপি করছে। এভাবে চাপাচাপি না করে ব্যবসায়ীদের তেলের জোগান ঠিক করে দিলে আমরা ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু আপনি আমার তেল পাওয়ার ব্যবস্থাও করতে পারবেন না, আবার চাপাচাপিও করবেন, তা হতে পারে না।
এ সময় মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বশির উদ্দিন বলেন, ‘মিলগেটে তেলের জন্য গিয়ে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে, এ রকম ঘটনাও আছে। অথচ যে কোনো মুহূর্তে তেল পাওয়া যেতে পারে, এমন পরিস্থিতির জন্য আমরা ট্রাকও ছেড়ে দিতে পারি না। এতে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত গচ্চা দিতে হয়।’
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা দাবি করেন, মিলমালিকদের পক্ষ থেকে বাজারে সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিদিন দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মেট্রিক টন তেল সিটি গ্রুপের কারখানা থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনিও কোরবানি পর্যন্ত ভোজ্যতেলেরর ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। এস আলম গ্রুপের সিনিয়র মহা-ব্যবস্থাপক কাজী সালাহউদ্দিন আহাম্মদও এনবিআরকে ভ্যাট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
একই দাবি জানিয়ে টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল তাছলিম জানান, প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে সরকার ২৫ থেকে ২৭ টাকার রাজস্ব পায়। বর্তমান সময়ে এই রাজস্বছাড় দিলে রমজান পর্যন্ত তেলের বাজারে কোনো সংকট থাকবে না।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সহসভাপতি মো. হাবীব উল্লাহ ডন, পরিচালক হারুন অর রশীদ, আবু হোসাইন ভুঁইয়া (রানু), মহাসচিব মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন প্রমুখ।