পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঘোষিত হয়েছে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। জাতীয় বাজেটকে ঘিরে তাদের আশা ছিল অনেক। উদ্বেগও কম ছিল না। পুঁজিবাজারে গতিশীলতার প্রয়োজনে জাতীয় বাজেটে বিবেচনার জন্য নানা প্রস্তাব বা সুপারিশ করেছিল বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার। এখন তাদের হিসাব মিলিয়ে নেওয়ার পালা- বাজেটে পুঁজিবাজার কি পেয়েছে, আর কি পায়নি।
আজ বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। এতে নানা সরকারের আয়-ব্যয়, নানা খাতে বরাদ্দ ও শুল্ক-কর সংক্রান্ত নানা প্রস্তাব রয়েছে। এসব প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট খাত ও জনজীবনে নানা মাত্রায় প্রভাব ফেলবে। আর পুঁজিবাজারও এর বাইরে নয়।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)সহ বিভিন্ন স্টেহোল্ডার নানা প্রস্তাব দিয়েছিল
স্টেকহোল্ডারদের দেওয়া বেশিরভাগ প্রস্তাবই প্রতিফলিত হয়নি ঘোষিত বাজেটে। অবশ্য কোনো বাজেটেই এই ধরনের সুপারিশমালার সম্পূর্ণ প্রতিফলন থাকে না। কারণ স্টেকহোল্ডাররা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং নিজেদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় নিয়ে নানা প্রস্তাব দিয়ে থাকে। অন্যদিকে সরকারকে বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা করে এবং তার সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করতে হয়।
নিচে পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডারদের নানা প্রস্তাব ও ঘোষিত বাজেটে সেগুলোর প্রতিফলনের বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।
কর্পোরেট করহার কমানো
পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডাররা তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হার কমানো এবং তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির মধ্যকার করহারের ব্যবধান বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার সাড়ে ৭ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেছিল তারা। বর্তমানে এমব কোম্পানিকে সাড়ে ২২ শতাংশ কর দিতে হয়। তাদের প্রস্তাবনা ছিল-এটিকে কমিয়ে যেন ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
এই প্রস্তাবনার বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের যুক্তি ছিল, করপোরেট করের হার কমানো হলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা ও লভ্যাংশ বিতরণের সক্ষমতা বাড়বে। আর ভাল লভ্যাংশ পেলে এই বাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে দেশের মানুষ। তাতে বাজারে গতিশীলতা ও স্থিতিশীলতা বাড়বে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সুপারিশে, তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির করপোরেট কর হারে ন্যুনতম ১০ শতাংশ ব্যবধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। অন্য স্টেকহোল্ডররাও একই ব্যবধানের দাবি জানিয়েছিল। তাদের মতে, করপোরেট করের হার কমানো ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির সাথে করের ব্যবধান বাড়ানো হলে ভাল ভাল কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হবে। আর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার কারণে কোম্পানিগুলোর পারফরম্যান্স ভাল হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।
বাজেটে স্টেকহোল্ডারদের এই প্রস্তাবনার আংশিক প্রতিফলন ঘটেছে। অর্থমন্ত্রী কিছু ব্যতিক্রম বাদে তালিকা-বহির্ভূত ও তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির করপোরেট করের হার ২ দশমিক ৫০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেছেন। তবে প্রস্তাবের চেয়ে কম হারে কর কমানোর প্রস্তাব করা হলেও এটিকে ইতিবাচকই মনে করছেন স্টেকহোল্ডাররা।
উভয় ধরনের কোম্পানির কর হার আড়াই শতাংশ কমানোর কারণে তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির কর হারের ব্যবধান অপরিবর্তিত থাকছে, বাড়ছে না। বর্তমানে এই দুই ধরনের কোম্পানির কর হারের ব্যবধান সাড়ে ৭ শতাংশ।
কিন্তু তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির করহারের ব্যবধান অপরিবর্তিত থাকায় ভাল কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে সেটি বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে বিবেচিত হবে না। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে নানা ধরনের কমপ্লায়েন্স পরিপালন করতে হয়। এতে কোম্পানিগুলোকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়। ফলে কর রেয়াতের প্রকৃত কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না। তাছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে নানা মনিটরিংয়ের মধ্যে থাকতে হয় বলে এখানে কর ফাঁকির সম্ভাবনা কম। কিন্তু তালিকার বাইরে থাকলে সহজেই কর ফাঁকি দেওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ফাঁকির বিপরীতে কর রেয়াতের হার তেমন কিছুই না।
কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রায় সব স্টেকহোল্ডারের কমন দাবি ছিল, আগামী অর্থবছরের বাজেটে যেন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা (তাদের ভাষায়-অপ্রদর্শিত অর্থ) সাদা করার সুযোগ রাখা হয়। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ আয়কর ধার্য করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তারা। খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) ১০ শতাংশ সরল হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল অর্থমন্ত্রণালয়ের কাছে।
কালো টাকা বিনিয়োগের পক্ষে স্টেকহোল্ডারদের যুক্তি, বিনা প্রশ্নে পুঁজিবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিলে বাজার যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনই সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। পাশাপাশি কমবে অর্থ পাচার।
তবে প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি। আগে সুযোগ দেওয়ার পর তেমন সাড়া না পাওয়ায় এই সুযোগ আর রাখা হচ্ছে না বলে বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন অথর্মন্ত্রী। অর্থাৎ আগামী অর্থ বছরে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ আর থাকছে না।
দ্বৈত কর প্রত্যাহার
স্টেকহোল্ডাররা তালিকাভুক্ত কোম্পানির লভ্যাংশ বাবদ আয় থেকে কেটে রাখা করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
নিয়ম অনুসারে, প্রতিটি কোম্পানিকে তার আয়ের উপর কর দিতে হয়। এরপর নিট মুনাফা নির্ধারিত হয়। ওই মুনাফা থেকে কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করলে ওই লভ্যাংশ বিতরণের সময় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর কেটে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে আবার লভ্যাংশ গ্রহীতার ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্নের সময় তার ওপর প্রযোজ্য হারে কর দিতে হয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ গ্রহণ না করে রেকর্ড তারিখের আগেই শেয়ার বিক্রয় করে দেয়, যা পুঁজিবাজারকে অস্থির করে তুলে। এভাবে কর প্রদান দ্বৈত কর নীতির আওতায় পড়ে। এক্ষেত্রে অগ্রিম করকে চূড়ান্ত কর হিসাবে বিবেচনা করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন তারা।
দ্বৈত কর প্রত্যাহারের প্রস্তাবে সাড়া দেননি অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন নেই। বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্যই করেননি অর্থমন্ত্রী। এর অর্থ লভ্যাংশ বিতরণের সময় কেটে রাখা আয়কর লভ্যাংশ গ্রহীতা বিনিয়োগকারীর চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচিত হবে না। তাকে এই লভ্যাংশের উপরেও প্রযোজ্য হারে কর দিতে হবে।
করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা বৃদ্ধি
পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডাররা করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা বাড়িয়ে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিলেন। বর্তমানে এই সীমা ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৫০ হাজার টাকা লভ্যাংশ আয় পর্যন্ত কোনো কর দিতে হয়নি। কোনো বিনিয়োগকারী এরচেয়ে বেশি লভ্যাংশ পেলে বাড়তি লভ্যাংশ তার অন্যান্য আয়ের সাথে যোগ করে মোট আয়ের উপর প্রযোজ্য হারে কর ধার্য করা হয়।
করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা বাড়লে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে লভ্যাংশের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে। বৃদ্ধি পাবে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের প্রবণতা। তাতে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা বাড়বে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা বাড়ানোর বিষয়ে কিছু বলেননি। তাই ধরে নেওয়া যায়, বর্তমান সীমা-ই বহাল থাকবে। তবে অর্থবিল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাবে না। অর্থবিলে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা থাকলেও থাকতে পারে।
কুপনযুক্ত বন্ডের আয় করমুক্ত রাখা
বর্তমানে জিরো-কুপন বন্ডের (যে বন্ডে সুদ বা মুনাফা বিতরণের কোনো কুপন যুক্ত থাকে না) আয়ে করমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। সব ধরনের বন্ড জনপ্রিয় করে একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট চালুর লক্ষ্যে কুপনযুক্ত বন্ডের আয়কেও একই সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল বিএসইসি।
ঘোষিত বাজেটে বন্ডের আয়ে কর সংক্রান্ত কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে কুপনযুক্ত বন্ডের আয় করমুক্ত হচ্ছে না। অর্থাৎ এই ধরনের বন্ডের আয়ের উপর কর দিতে হবে।
সিকিউরিটিজ লেনদেনে অগ্রিম আয়কর কমানো
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) সিকিউরিটিজ লেনদেনের ওপর বিদ্যমান অগ্রিম আয়করের হার কময়ে ০.০১৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্রোকার ও বিনিয়োগকারী লাভবান হবে। বাজারে লেনদেন বাড়বে। আর দীর্ঘ মেয়াদে তাতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট কর কমানো
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) মার্চেন্ট করপোরেট করের হার কমানোর প্রস্তাব করেছছিল। বর্তমানে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে ববাণিজ্যিক ব্যাংকের সমান হারে অর্থাৎ ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা বাড়ানোর বিষয়ে কিছু বলেননি। তাই ধরে নেওয়া যায়, বর্তমান সীমা-ই বহাল থাকবে। তবে অর্থবিল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাবে না। অর্থবিলে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা থাকলেও থাকতে পারে।