আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইতিমধ্যে ১৩ মার্চ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী, ২২ মার্চ নাগরিক সমাজ, ৬ এপ্রিল প্রিণ্ট মিডিয়ার সম্পাদক/সিনিয়র সাংবাদিক, ১৮ এপ্রিল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধান নির্বাহী/প্রধান বার্তা সম্পাদক/সিনিয়র সাংবাদিক এবং ৯ জুন নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ সম্পন্ন হয়েছে। এবার নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের (সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার ও সচিব) সঙ্গে বসবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। এই ধাপের সংলাপ শেষ হলে নিবন্ধিত রাজনৈতক দলগুলোর প্রতিনিধির সঙ্গে সংলাপ শুরু করার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এই বিষয়ে ইসির যুগ্মসচিব ও পরিচালক (জনসংযোগ) এসএম আসাদুজ্জামান বাংলাভিশনকে বলেন, রবিবার (১২ জুন) নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপে বসবে কমিশন।
জানা যায়, রবিবার সকাল ১১টায় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সম্মলেন কক্ষে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মতবিনিময় সভায় নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সাবেক সকল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), নির্বাচন কমিশনার, সাবেক ইসি সচিবদের সংলাপে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এছাড়া কয়েকজন ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিবও সংলাপে অংশ নিতে পারেন।
সাবেক সকলকে সিইসি, ইসি ও সচিবদের আমন্ত্রণা জানানো হলেও শারীরিকভাবে অসুস্থ ও বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করার কারণে অনেকেই ইসির সংলাপে অংশ নিতে পারছেন না। তবে সাবেক সিইসি বিচারপতি মো. আব্দুর রউফ, ড. এটিএম শামসুল হুদা ও কেএম নূরুল হুদা সংলাপে উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে। এছাড়া সাবেক নির্বাচবন কমিশনারদের মধ্যে মো. শাহনেওয়াজসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত থাকবেন। সাবেক সচিবদের মধ্যে মো. আবদুল্লাহ’র উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, প্রিণ্ট মিডিয়ার সম্পাদক/সিনিয়র সাংবাদিক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধান নির্বাহী/প্রধান বার্তা সম্পাদক/সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপে ইসি যেসব মতামত, পরামর্শ ও প্রস্তাবনা পেয়েছে:
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে অর্থাৎ নির্বাচনে সকল এবং বিশেষত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; নির্বাচন অবাধ হতে হবে। ভোটারদের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগে সম্ভাব্য সকল প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; নির্বাচনে সম্ভাব্য সকল কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে শুদ্ধ ও নিরপেক্ষ ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে; ভোটকেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগে অর্থশক্তি ও পেশিশক্তির ব্যবহার ও প্রভাব প্রতিরোধ করতে হবে; রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রশাসনের কর্মকর্তাগণকে বাদ দিয়ে বা তাদের পাশাপাশি যতদূর সম্ভব কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা বা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদেরকে নিয়োগ দেয়া সমীচীন হবে; ভোটের সময় ভোটকেন্দ্রে অনুমোদিত সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে হবে; ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অবাধ সুযোগ দিতে হবে; ভোটারগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ অবাধ, নির্বিঘ্ন, স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান করতে সিসি ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরের দৃশ্য বাহির থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ প্রদান করা যেতে পারে;
ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে সম্ভাব্য সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এবিষয়ে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে; প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে ভোটের সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে; প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রতুলতা হলে নির্বাচন একাধিক দিনে কয়েকটি ভাগে অনুষ্ঠান করা যেতে পারে; ইভিএম এর শুদ্ধতা ও অপপ্রয়োগ প্রতিরোধ নিশ্চিত করা না গেলে ইভিএম এর ব্যবহার পরিহার করে কাগজী ব্যালটের মাধ্যমে ভোট অনুষ্ঠান করতে হবে; ইভিএম এর শুদ্ধতা ও সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে ইভিএম এর ব্যবহার বিস্তৃত করা যেতে পারে; নির্বাচন কমিশনকে গৃহীত শপথের প্রতি অনুগত থেকে সৎ, নিরেপক্ষ ও সাহসী হয়ে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সংবিধান ও আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা সততা ও সাহসিকতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে; নির্বাচন কমিশনকে আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠে দেশবাসীর নিকট আস্থাভাজন হতে হবে; এবং নির্বাচন যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্ত হচ্ছে তা দৃশ্যমান হতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের যা মতামত:
ইসি জানায়, স্টেক হোল্ডারদের মতামত ও পরামর্শসমূহ গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে দেখা হয়েছে। এ পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখা হবে। সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কমিশন যথাযথ করণীয় নির্ধারণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিশিষ্টজনদের মতামত ও প্রস্তাবনাসমূহের বিষয়ে কমিশনের মতামত হচ্ছে-
অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন-আকাঙ্খা ও গুরুত্ব নির্বাচন কমিশন সর্বদা অনুধাবন করে থাকে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে কমিশন সাধ্যমত চেষ্টা করে যাবে। সকল রাজনৈতিক দল বিশেষত: প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে অচিরেই সংলাপে আহ্বান করা হবে; ভোটকেন্দ্রে ও ভোটাধিকার প্রয়োগে অর্থশক্তি ও পেশিশক্তির প্রভাব প্রতিরোধ করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের, বিশেষত: আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সহায়তা প্রয়োজন হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলসমূহ ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণকেও এলক্ষ্যে স্ব স্ব অবস্থান থেকে অতন্দ্রিত ভূমিকা পালন করতে হবে; নির্বাচনে অর্থশক্তি ও পেশিশক্তির প্রভাব প্রতিরোধ করতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলসমূহ ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণকেও সজাগ দৃষ্টি রেখে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, মতৈক্য ও সমঝোতা এহেন সমস্যা নিরসনে প্রভূত ভূমিকা রাখতে পারে; নির্বাচনে কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে অবাধ ও নিরপেক্ষ ফলাফল নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন সম্ভব সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলসমূহ ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণকেও এবিষয়ে সজাগ থেকে নজরদারিসহ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে;
প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রতুলতা হলে নির্বাচন একাধিক দিনে কয়েকটি ভাগে সম্পন্ন করা যেতে পারে মর্মে প্রস্তাবনা বিষয়ে কমিশন সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বিষয়টির সম্ভাব্যতা, উপযোগিতা, সুবিধা, অসুবিধা ইত্যাদি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে; ভোটের সময় ভোটকেন্দ্রে ভোট কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য অনুমোদিত সাংবাদিকদের এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অবাধ সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করতে কমিশন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে; স্বচ্ছতার জন্য ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরভাগের দৃশ্য বাহির থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করার বিষয়টি কমিশন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে; এবং ইভিএম এর শুদ্ধতা ও অপপ্রয়োগ রোধ নিশ্চিত করতে কমিশন ইতোমধ্যে কয়েকটি সভা করেছে। পরীক্ষা ও পর্যালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিমিত্ত আগামীতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ বিশিষ্টজনদের অংশগ্রহণে আরো পর্যালোচনা সভার আয়োজন করা হবে। অতঃপর কমিশন আগামী জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে ইভিএম এর ব্যবহার বা ব্যবহারের পরিধি ও বিস্তৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। নির্বাচনের মাধ্যমেই সংসদ ও সরকার গঠিত হয়ে থাকে। সকলের অংশগ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সফল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কমিশন তার প্রয়াস নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রাখবে বলেও ইসির লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। নিয়োগ পাওয়ার পরদিন শপথ নিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম অফিস করে নতুন কমিশন। এরপর আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৩ মার্চ শিক্ষাবিদদের মাধ্যমে ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন।