ফের আলোচনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ যাত্রা। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের পর তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার ও দলের নেতাকর্মীরা। তাকে দ্রুত বিদেশ পাঠানোর দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে তাদের করার কিছু নেই। এটা এখন সম্পূর্ণ আদালতের ব্যাপার। সরকারের এমন ঘোষণার পর করণীয় নিয়ে ভাবছে বিএনপির হাইকমান্ড। পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে দলীয় আইনজীবীদের। বেশিরভাগ আইনজীবীই মনে করেন, চেয়ারপারসনের বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকারকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া আদালতে গিয়ে লাভ হবে না। আদালতে যাওয়াটা অনেকটা সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।
এদিকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো নিয়ে পর্দার আড়ালে সরকারের সঙ্গে ফের সমঝোতার চেষ্টা চলছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হতে পারে। যাতে তারা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। শনিবার ভোররাতে অসুস্থবোধ করলে খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার হার্টে সমস্যা ধরা পড়ে। মেডিকেল বোর্ড তার এনজিওগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়। এনজিওগ্রাম করার পর তার হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে একটি রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়ার হার্টের সমস্যায় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা যায়। অনেকেই হাসপাতালে ভিড় করছেন।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চেয়ারপারসনের অবস্থা অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল ছিল। চিকিৎসকদের সময়োচিত পদক্ষেপ এবং চিকিৎসার কারণে অতিদ্রুত স্টেন্টিং করে তার লাইফ সেইভ করা হয়েছে। এটাই তার শেষ নয়। তার অনেক অসুখ আছে। লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, কিডনি ডিজিস। এজন্য উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্র প্রয়োজন। যা আমাদের দেশে নেই। চিকিৎসকরা বলেছেন, তাকে উন্নত মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া। আমরা বারবার সরকারকে অনুরোধ করেছি, আন্দোলন করেছি। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করছে না।
খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিরা বলেছেন, এটা আদালতের বিষয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। দেশের মাটিতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যদি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান তাহলে আদালতে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে। আদালত ছাড়া এ রাস্তাটি খোলা নেই।
এদিকে খালেদা জিয়ার সবশেষ অবস্থা প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ম্যাডামের হার্টে এনজিওগ্রাম করার পর তিনটা ব্লক পাওয়া যায়। একটা ব্লক মেইন গ্রেট ভেসেল, যেটা লেফট সাইডে, সেটায় মোর দ্য ৯৫% ব্লক ছিল। এ কারণে উনার হার্ট অ্যাটাক হয়। এনজিওগ্রামে ওখানে সঙ্গে সঙ্গে স্টেন্টিং করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত উনি শারীরিকভাবে যে অবস্থায় আছেন তাতে ৭২ ঘণ্টা না গেলে কোনো কমেন্ট করা ঠিক হবে না।
তিনি আরও বলেন, বাকি দুটি ব্লকের বিষয়ে উনার শরীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা করা হবে। কারণ উনার ক্রনিক কিডনি ডিজিজ আছে, ক্রনিক লিভার ডিজিস আছে, এক্ষেত্রে যেসব ওষুধ ইউজ করতে হয়, তাতে কিডনির ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সেজন্য আরও দুটি ব্লক অপসারণের কাজটি বাকি রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিকবার আবেদন করা হয়েছে। আইনি দিক পর্যালোচনা করে আবেদন নাকচ করে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে ফের আবেদন করে কোনো লাভ হবে না।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা গুরুতর এ নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। সরকারও বিষয়টি অবহিত। তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন তা নিয়েও কারও দ্বিমত নেই। কিন্তু সরকার তাকে বিদেশ পাঠাতে চায় কিনা সেটাই মুখ্য। আদালতে যেতে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্যকে দুভাবে দেখা যেতে পারে। এক. সরকার যেহেতু নির্বাহী আদেশে তাকে বিদেশ পাঠাতে চাচ্ছে না সেক্ষেত্রে তারা বিষয়টি ফয়সালায় আদালতের ওপর ছেড়ে দিতে চাইছে। দুই. আদালতে যাওয়ার কথা বলে বিষয়টি নিয়ে ফের বিএনপিকে নাস্তানুবাদ করতে চাইছে। আদালত বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিলে সেক্ষেত্রে এ নিয়ে আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। তাই সবকিছু বিবেচনা করেই এ ব্যাপারে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন যুগান্তরকে বলেন, আদালতে গেলেই খালেদা জিয়াকে জামিন দিয়ে দেবে এটা আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা তো সর্বোচ্চ আদালতে চেষ্টা করেছিলাম। সে সময় বলেছিলাম, সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া তার জামিন হবে না। সরকার তখনো বলেছিল, তাদের করার কিছু নেই।
তিনি বলেন, সরকারি আদেশের বলে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়। সরকার নতুন করে একটা অর্ডার দিলেই তার বিদেশ যাওয়া সম্ভব। শর্ত দিয়ে তাকে বিদেশ পাঠাতে পারেন। সরকার চাইলে সবই পারেন। এমনকি আদালতে গেলেও সরকারের সদিচ্ছা লাগবে। তাদের সদিচ্ছাই হচ্ছে মূল কথা। সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া কিছুই হবে না। আদালতে যাওয়ার কথা বলে ফের নাস্তানুবাদ করতে চাইছে কিনা সে বিষয়টিও আমাদের ভাবতে হচ্ছে।
আরেক আইনজীবী ও দলের যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়াকে উচ্চ আদালত জামিন দেননি। সরকার বিরোধিতা না করলে তিনি জামিন পেতেন। আদালত নয়, সরকারের নির্বাহী আদেশে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। সরকার ইচ্ছা করলে শর্ত প্রত্যাহার করে তাকে বিদেশ পাঠাতে পারেন।
তিনি বলেন, সরকার তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে এটা করতে পারেন। কিন্তু তা না করে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এটা তাদের কূটকৌশল, চালাকি। আমরা যদি আদালতেও যাই তাহলেও সরকারের নির্দেশ ছাড়া তার জামিন হবে না। কারণ বিচার বিভাগ এখনো স্বাধীন নয়। কোনো বিচারক ঝুঁকি নেবেন না।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামালও একই মত তুলে ধরে বলেন, আদালত দেখিয়ে সরকার তার দায়িত্ব থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। সরকারি দলের সাজাপ্রাপ্ত সংসদ সদস্য বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সময় তো আদালতের নির্দেশ লাগে না। খালেদা জিয়ার বিষয়টি কেন তারা আদালতে নেন। আদালত দেখাচ্ছেন কারণ সরকার চায় খালেদা জিয়া তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হোক।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকার চাইলেই তা বাস্তবায়ন করতে পারে। তারা যে শর্ত দিয়েছে তা তুলে নিলেই হলো। এ বিষয়টি সরকারের হাতে, আদালতের হাতে নয়।