চীনের সহায়তা ছাড়া অর্থনৈতিক পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো শ্রীলঙ্কার ঋণ পুনর্গঠন সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বর্তমানে ঋণখেলাপির কারণে সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটি। জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি দেশটি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাদ্য ও ওষুধ সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় জনগণের হতাশা বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং জনগণের ক্ষোভের কারণে গত সপ্তাহে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। গত বুধবার নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য সংসদে ভোটের আগে বিক্ষোভ দমনে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার উমেষ মুরামুদালি বলেন, শিগগির ঋণ পুনর্গঠন করতে ও দেশটিকে তার বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে ঋণ ও ত্রাণদানে চীনের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত মঙ্গলবার মুরামুদালি মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসি-এর ‘স্ট্রিট সাইনস এশিয়া’ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘চীন ছাড়া শ্রীলঙ্কা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। চীনকে শ্রীলঙ্কার ঋণ পুনর্গঠন করতে রাজি হতে হবে, যা তাদের জন্য সহজ নয়।’
বেল্ট অ্যান্ড রোড: চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভের আওতায় শ্রীলঙ্কায় বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছে। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় বন্দর, সড়ক, রেলওয়ে, পাইপলাইন নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে বিশাল অবকাঠামো কর্মসূচি চালু করে চীন।
মুরামুদালি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমরা আলোচনার কোনো পর্যায়ে আছি তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে চীন ঋণ পুনর্গঠন করতে একটি সাধারণ কাঠমোয় আসতে রাজি হয়েছে এবং শ্রীলঙ্কারও একটি সাধারণ কাঠামোয় আসা প্রয়োজন।’
গত সপ্তাহে একটি নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন জানান, শ্রীলঙ্কা সরকার আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত করার ঘোষণা করার কিছুক্ষণ পর, চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রীলঙ্কার পক্ষে অবস্থান নেয় এবং চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঋণ পরিচালনা ও শ্রীলঙ্কাকে বর্তমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠায় সহায়তা করতে একটি সঠিক উপায় খুঁজে বের করার জন্য অঙ্গীকার করেছে।
২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে বেইজিং কৌশলগতভাবে দেশটির একটি বন্দর দখল করে নেয়। সমালোচকরা বেইজিংয়ের বিনিয়োগকে ঋণের ফাঁদ বলে অভিযুক্ত করেছেন। তারা বলছেন, দেশগুলো চীনের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ যদি পরিশোধ করতে না পারে তবে জাতীয় অঞ্চলের জন্য চুক্তি করতে বা ছাড় দিতে বাধ্য হতে পারে। চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
শ্রীলঙ্কা বলছে, গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত, মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ ছিল চীন থেকে নেয়া। কিন্তু মোরামুদালির মতে, বিষয়টি সম্ভবত এমন নয়। তিনি বলেন, আমি বলতে চাচ্ছি, এই ১০ শতাংশ ঠিক নয়, শ্রীলঙ্কায় চীনের ঋণ দেয়ার সঠিক চিত্র পেতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। চীনা ঋণদাতাদের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা আসলে ১০ শতাংশ নয়, প্রায় ২০ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। তাই এই পুরো ২০ শতাংশকে পুনর্গঠন করতে হবে। অর্থাৎ দেখতে হবে, কীভাবে চীনা উন্নয়ন ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠন করে ও এক্সিম ব্যাংক কীভাবে পুনর্গঠনের কাজ মোকাবিলা করে।
দুঃখজনক ভুল: সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায় রাজাপক্ষে জুনে বলেন, শ্রীলঙ্কা ও চীন ১৫০ কোটি ডলারের ক্রেডিট লাইন ও ১০০ কোটি ডলারের সিন্ডিকেট ঋণ নিয়ে আলোচনা করছে। গত সপ্তাহে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন বলেন, শ্রীলঙ্কার ঋণ পুনর্গঠন করা হবে চীনের স্বার্থে। চীন অবশ্যই শ্রীলঙ্কার গুরুত্বপূর্ণ পাওনাদার। দেশটি স্পষ্টত চীনের ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম। আমার আশা, ঋণ পুনর্গঠন করতে চীন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কাজ করতে চাইবেÑকারণ চীন ও শ্রীলঙ্কা উভয়ের জন্য এটি ভালো হবে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, চীনের ঋণের জন্য এই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়া উদ্যোগের পরিচালক অখিল বেরি গত মঙ্গলবার সিএনবিসি-এর ‘স্কোয়াক বক্স এশিয়া’-কে বলেন, শ্রীলঙ্কার একটি মারাত্মক ভুল ছিল ২০২০ সালে যখন মহামারি আঘাত হানে তখন দেশটি তার ঋণদাতাদের সঙ্গে পুনর্গঠন আলোচনা করেনি। ওই সময় জানা যায়, ঋণটি টেকসই নয়। দেশটির রাজনীতিবিদদের ধারণা ছিল, চীন তাদের সাহায্য করবে এবং তাদের ঋণ পুনর্গঠন করবে।
মোরামুদালি বলেন, নতুন সরকার আন্তর্জতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে আলোচনা যাবে। তবে চুক্তি চূড়ান্ত করতে কয়েক মাস লাগবে। মহামারিতে সংস্থা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমানে তারা করহার বৃদ্ধি, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাসহ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।