মোবাইল ফোন ছাড়া এখন আমাদের এক মুহূর্ত টেকা দায়। সবার প্রতিদিনের সঙ্গীর মত এই এনড্রয়েড ডিভাইস আমরা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, চলার পথে বেশ কিছু অপৃতিকর ঘটনায় সবার প্রিয় মোবাইল সেটটি খোয়া যায়। বিশেষ করে-চুরি এবং ছিনতাইয়ের কবলেই মোবাইল হারানোর ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। মূলতঃ এর পর থেকেই শুরু হয় হয়রানি। এবং চরম ভোগান্তির অনেক অভিজ্ঞতাপুষ্ট গল্প অথবা কারও জীবনের স্বরণীয় ঘটনা।
নিজের জিনিস হারিয়েও মানুষকে বেশি চিন্তিত হতে হয় এই কারণে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মোবাইলটি দিযে ছিনতাইকারীচক্র যদি কোন অন্যায় অপরাধমূলক কাজে ফোনটি ব্যবহার করে থাকে, নিজের জিনিস হারিয়ে পরে অসহায় মানুষটিকে উল্টো আরও হেনস্তার শিকার হতে হয়। ভুগতে হয় নানান হয়রানিতে। এটাই স্বাভাবিক, মোবাইল এবং সিমের রেজিস্ট্রি অনুসারে মোবাইলটির প্রকৃত মালিককেই পুলিশ জেরা, হয়রানি কিংবা গ্রেফতারও করার নজির আছে। সেই কারণে যে কারও মোবাইল ফোন হারালে, চুরি হলে অথবা ছিনতাই হলে সাথে সাথে পুলিশকে জানানো উচিত। যদিও বেশিরভাগ মানুষ দাম দিয়ে আরও একটি নতুন মোবাইল সেট কিনতে ছুটে যান। জেনে শুনে তবু থানা পুলিশের ঝুক্কি ঝামেলায় পড়তে চান না অনেকে। এটার প্রধান কারণ কিন্তু পুলিশ আর সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের মৌন দূরত্ব। এবং নাগরিকের প্রতি পুলিশের যে দায়িত্ববোধ সেটার প্রতি মানুষের পূর্ণ আস্থার অভাববোধ। তবুও অনেকেই আবার পুলিশের কাছে ছুটে যান, প্রিয় মোবাইলটিকে শুধু একটি ডিভাইস না ভেবে। এটি যার যার কাছে একটি তথ্য ব্যাংকের মতই এতদিন ছিলো আস্থার প্রতীক হয়ে। কত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, ছবি, আরও কত দরকারি ফিচারে ঠাসা মোবাইলটির জন্য মানুষের ভিড় আপনি রোজ ঘরের কাছে যে কোন থানায় গেলেই পরখ করতে পারবেন। থানায় গিয়ে সিরিয়াল ঠেলে মূল্যবান মোবাইল ফোনটি হারিয়ে গেলে বা ছিনতাই হলে নিকটস্থ থানায় একটি সাধারণ ডায়রি বা জিডি করতে হয়। সেই সাথে মোবাইলটির প্রয়োজনীয় কাগজ হিসেবে মোবাইল ক্রয়ের রশিদ, সিম রেজিস্ট্রেশন ফরম, ফোনের আইএমই নম্বর, ফোনের সক্রিয় সিমের নাম্বার প্রভৃতি কাগজ অথবা ফটোকপি জিডির সাথে থানায় জমা দিতে হয়। ডিউটিরত অফিসার আবেদনকারীকে একটি জিডি নাম্বার প্রদান করে থাকেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোবাইল ফোনটির আইএমইআই নম্বর দিয়ে ট্র্যাক করে ফোনটি উদ্ধারের চেষ্টা করে থাকে। পরবর্তীতে হারানো মোবাইলটি যদি খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে উক্ত থানার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা হিসেবে ওসির মাধ্যমে আবেদনকারীকে তা ফেরতের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে, “ কারও মোবাইল ফোন খুঁজে না পাওয়া গেলেও আবেদনকারীকে তা জানিয়ে দেয়া হবে। তবে হারানো বা ছিনতাই হওয়া মোবাইলটি যদি খুঁজে পাওয়া যায় এই সেবায় পুলিশের প্রতি মানুষের শতভাগ আস্থা ফিরে আসবে। সেই সাথে মানুষের অযথা হয়রানি থেকেও মুক্তি মিলবে, পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির হাত থেকেও কিন্তু রক্ষা পাওয়া যাবে। মোট কথা পুলিশ যে নাগরিকের রক্ষক আর পুলিশ জনগণের মধ্যে নিশ্চিত এক ধরণের মৈত্রীর বন্ধনও কিন্তু গড়ে উঠবে নিশ্চিত। আর হারানো মোবাইল উদ্ধারে পুলিশের উল্লেখযোগ্য যেসব সেবার কথা বলা হয়েছেঃ বিনামূল্যে এই সেবা প্রদান করা হয়, প্রয়োজনীয় সময় ২ থেকে ৭ দিন, কাজ শুরু হবে নিকটস্থ থানায়, আবেদন করা যাবে সারা বছর যে কোন সময়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি, এস আই অথবা এ এস আই, আর কেউ যদি থানায় সেবা না পেয়ে থাকেন তারা যাবেন সার্কেল এ এস পি’র কাছে আর বিস্তারিত তথ্যের জন্য পুলিশের হেল্প ডেস্ক আছে, ১০০ পুলিশ কন্ট্রোল রুম আর ৯৯৯ ন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক।”
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুসারে চোরাই মোবাইল বিক্রি অবৈধ। তারপরও চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি করা মোবাইল ফোন চোরাই মোবাইলের অবৈধ ব্যবসার সাথেই ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। পথচারীর ছিনতাই করা ও বাস থেকে পিক পকেট করা মোবাইল এসব চক্রের প্রধান টার্গেট থাকে। ঢাকার প্রতিটি ব্যস্ত সড়ক, ব্যস্ত এলাকাতেই ছিনতাই ও মোবাইল কেনাবেচার সিন্ডিকেট চক্রের আনাগোনা চলছে। মোবাইল ফোনের ১৫ ডিজিটের আইএমইআই ইকুইপমেন্ট আইডেনন্টিটি নম্বরের মাধ্যমে মোবাইল ফোন ট্র্যাক বা সনাক্ত করা যায়। যেই ফোনে কোন আইএমইআই নম্বর থাকে না বুঝতে হবে সেটাই জাল । এবং যে কোন অপরাধমূলক কাজে এই ধরনের মোবাইল অপরাধীরা বেশি ব্যবহার করে থাকে। এখন প্রশ্ন একটাই, এত মানুষের মোবাইল ছিনতাই ও সেট যে হারানো যায়, মানুষ থানার দারস্থ হন, সব মোবাইল ফোন কি খুঁজে পাওয়া যায়? সাধারণ ডায়েরি তো রোজ সব থানাতেই বসে অফিসাররা কাগজে টুকে রাখছেন। ফায়দা হয় কয়জনের? প্রযুক্তবিদরাই বলেন, ‘চুরি ছিনতাই হওয়া সেকেন্ডহ্যান্ড মোবাইল কিনে কেউ যদি ব্যবহার করেন তাহলে সেগুলো উদ্ধার সম্ভব। কিন্তু এসব ফোন বেশিরভাগই হাত বদল হওয়ায় উদ্ধার করা কষ্টকর হয়। তবে সর্বশেষ যে ব্যক্তির কাছে মোবাইলটি যায় তিনি সরল বিশ্বাসে হয়ত কারও কাছ থেকে কিনে থাকতে পারেন। তিনি কিনে সিম সংযোগ দিলেই মোবাইল ফোনটি সনাক্ত করা যায়। মোবাইলের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়।’ তবে বেশিরভাগ ছিনতাই-চুরির মোবাইলের সিম, ব্যাটারী এসব খুলে ফেলে অপরাধীরা। অনেকসময় মোবাইলের বিভিন্ন পার্টস্ খুলেও আলাদা আলাদা এনে চোরাই মার্কেটে বিক্রি করে দেয়। এমনও শোনা যায়, একটি ব্রান্ডের ভালো মোবাইলের একটা ডিসপ্লের দামই আছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর আই ফোনের হলে তো ৪০ হাজার টাকাও এরা কামাতে পারে। এমনকি চোরাই মার্কেটে গিয়ে নেটওয়ার্ক আইসি এসব চেঞ্জ করে ফেলে। যে কারণে সেটের আইএমইআই নম্বরও চেঞ্জ হয়ে যায়। আর সেই মোবাইল আর উদ্ধার হয় না। ধরা-ছোয়ার বাইরেই থেকে যায় সমাজের মারাত্মক এসব অপরাধীচক্র। মোবাইল ছিনতাইকারী ও সিন্ডিকেট ধরতে প্রশাসনকে এসব চোরাই মার্কেট গুলো সিজ করতে হবে।
ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল ব্যবহারকারীরা প্রযুক্তির ভেতর এমনভাবে প্রবেশ করে, বর্হিজগত সম্পর্কে আর খেয়ালই থাকে না বলতে গেলে। সে কারণেই প্রতিদিন চলন্ত বাস ট্রেনের জানালা দিয়েও মোবাইল ছিনতাইকারীরা মোবাইল টান মেড়ে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। আবার এক শ্রেনীর মহিলা মোবাইল চোরের উৎপাত বেড়েছে। এদের আনাগোনা থাকে মার্কেট এরিয়াতে। শপিংয়ে গেলে যার যার এন্ডড্রয়েড আইফোন দামী মোবাইল ফোন এদের টার্গেটে পরিণত হয়। কিভাবে আপনার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে মোবাইল নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাবে, টেরই পাবেন না। এই ফোন মানুষের এতই প্রিয় যে ছিনতাইকারীর সাথে ফোন নিয়ে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মৃত্যুর খবরও ফলাও হয় দেশে। তারপরও দিনদুপুরে দেশের আনাচে কানাচের এসব মোবাইল ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশি এ্যাকশন যতটা কঠোর হওয়ার কথা, সেই কঠোরতা খুবই কমই দেখা যায়।
আর নিজের জিনিস হারিয়ে থানায় আসা মানুষের অভিযোগেরও কমতি নেই। জিডি করা নিয়েও সিরিয়ালে থাকতে হয়। তবে উপর মহলের ফোনে কেউ আসলে তার সাধারণ ডায়েরির সাথে ফোন উদ্ধারও সহজে সম্পুন্ন হয়ে যায়। তিতুমীর কলেজের জনৈক ছাত্র অনার্স পরীক্ষা দিতে গিয়ে খিলগাঁও ফ্লাইওভার এর কাছে খিলগাঁও পুলিশ ফাঁড়ির কাছে তুরাগ বাসে মোবাইল ছিনতাই চক্রের হাতে ২৫ শে মে ২০২২ তারিখে তার এনড্রয়েড মোবাইলটি হারায়। যথারীতি এলাকার থানায় সে জিডি করে আসে। কিন্তু এখনও তার মোবাইলটি কোন হদিস পুলিশ বের করতে পারেনি। পুলিশ তাকে বলেছিলো মামলা করতে। সে জানালো কে নিছে তা তো জানি না। পুলিশ জানায়- এ জন্যই তো রয়েছে অজ্ঞাতনামা মামলা ! ছেলেটা ছাত্র, ওসব মামলা টামলা না করে চলে আসে কোনমতে জিডি করে। তবে ভাগ্যবান জনৈক বেসরকারী চাকুরিজীবি। তিনি খিদমা হসপিটালের সামনে থেকে তার মোবাইলটি হারান। ২১ হাজার টাকা দামের মোবাইল। উনার দুই সন্তানের তোলা প্রিয় সব ছবির জন্য গিয়ে জিডি করে আসেন। তিন মাস না যেতেই পুলিশের পক্ষ থেকে ফোন আসে। তিনি ছুটে যান খুশিতে। কিন্তু গিয়ে শুনেন রংপুর থেকে ফোনটি উদ্ধার করা হয়। সে কারণে পুলিশি দাবী খরচাপাতির। তিনি রাতুল সাহেব অকপটেই জানান কিছু করার নাই ভাই। পাওয়া গেছে যখন আলহামদুলিল্লাহ নইলে নতুন মোবাইল কিনতে গেলে আবার ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ। তিনিই জানান, দামী মোবাইলের খরচাপাতির জন্য ৪ হাজার টাকা। আর আই ফোন হলে তো সেই খরচাপাতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় হাজার দশ বারোতে !
অথচ বিনামূল্যে নাগরিকের মোবাইল খুঁজে বের করার কথা রয়েছে সরকারি অধ্যাদেশে। এই চিত্র এখন দেশের প্রতিটি থানাতেই কমবেশি। আবার এর বিপরীত চিত্রও আছে। এমনও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা আছেন, সুনামের সাথেও অনেকের মোবাইলে উদ্ধার করে দিয়ে উনারা আজ জনতার উপকারি পুলিশ হিসেবেই ভাইরাল হয়েছেন। প্রতিটি থানার পুলিশের জন্যই এএসআই কাদের, এএসআই দুলাল হোসেন, পুলিশ উপ পরিদর্শক মিল্টন কুমার দে প্রমুখের মত বীর পুলিশরা সত্যিই অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারেন।
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি