গ্যাস সংকট ও জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে গত অর্থবছর রেকর্ড লোকসান গুনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চলতি অর্থবছর তা আরও বৃদ্ধি পাবে। এজন্য গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। চলতি মাস থেকে তা কার্যকর হয়। এর প্রভাবে লোকসানে পড়তে যাচ্ছে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়তে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, গত মাসেই বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) জমা দিয়েছে বিতরণকারী ছয় কোম্পানি। গড়ে ১৫-২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী ৮ ও ৯ জানুয়ারি প্রস্তাবগুলোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আর ফেব্রুয়ারিতে বর্ধিত কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর আগে ২১ নভেম্বর বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ বজলুর রহমান বলেন, ‘খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলে কমিশনে আবেদন করতে হবে। সেই আবেদনের ওপর গণশুনানি হবে। এর আগে ভূতাপেক্ষ বিবেচনায় কোনো দাম বাড়ানো যাবে নাÑআদেশে সেটা বলে দেয়া হয়েছে।’
মূল্য বৃদ্ধির বাড়তি চাপ কোম্পানিগুলো কীভাবে পূরণ করবেÑপ্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কতটা বাড়তি চাপ হবে সেটা আমরা এখনও জানি না। এর ফলে তাদের লোকসান হবে নাকি লাভের অঙ্ক কমে যাবে, সেটা হিসাব করলে বলা যাবে।’
যদিও বিদ্যুতের এ দাম বৃদ্ধির উদ্যোগকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। বরাবরই গতানুগতিক ঐকিক নিয়মে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করার প্রতি নির্দেশনা থাকে না। এ খাতে অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় করা হলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হতো না। এছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজন না থাকলেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। এ ধরনের কাজের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।
তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সাল থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ৯ বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় গড় বিদ্যুৎ বিল বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা।
২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ে ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে বাড়ে ১৫ শতাংশ। এতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। এরপর ২০১৪ সালের মার্চে বিদ্যুতের দাম ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ৬ টাকা ১৫ পয়সা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তা ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে হয় ৬ টাকা ৩৩ পয়সা।
এদিকে ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৬ টাকা ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওইবারই প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণকারী সবগুলো কোম্পানির জন্য অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। এতে ঢাকার চেয়ে বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের দাম বেশি হারে বাড়ে। এতে মূল্যহার কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। আর সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়ায় ৭ টাকা ১৩ পয়সা।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। ২০২০ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ১৩ পয়সা। অর্থাৎ ১০ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩ টাকা ৪০ পয়সা বা ৯১ দশমিক ১৫ শতাংশ।
২০২০ সালের মার্চে বর্ধিত মূল্যহার কার্যকরের ফলে সাধারণ গ্রাহকদের ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বেড়ে হয় ৪ টাকা ১৯ পয়সা। এছাড়া ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের জন্য ৫ টাকা ৭২ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ও ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৩৪ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়। আর ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৯ টাকা ৯৪ পয়সা ও ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের প্রতি ইউনিটে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা হারে বিল গুনতে হয়।
যদিও ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত ২ টাকা ৫০ পয়সা, ১০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত তিন টাকা ১৫ পয়সা ও ৪০০ ইউনিটের ওপরে পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হতো। পরের মাসে (মার্চে) তা বাড়িয়ে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত দুই টাকা ৬০ পয়সা, ১০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত তিন টাকা ৩০ পয়সা ও ৪০০ ইউনিটের ওপরে পাঁচ টাকা ৬৫ পয়সা করা হয়েছিল।