পাঠ্যসূচি হল শিক্ষাক্রমের অংশবিশেষ। কোনো শ্রেণিতে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কী কী বিষয়বস্তু পড়ানো হবে, তারই বিস্তারিত বিবরণ বা তালিকা হচ্ছে পাঠ্যসূচি। শিক্ষাক্রমকে একটি বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হলে পাঠ্যসূচি হবে ওই বৃক্ষের একটি শাখা। শিক্ষাক্রম শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ এবং সামগ্রিক রূপরেখা।
একটি দেশের শিক্ষাক্রম ও এর কাঠামো যেসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে সেগুলো হচ্ছে জাতীয় দর্শন, রাষ্ট্রীয় আদর্শ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোগত অবস্থা, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য, জাতিগত মূল্যবোধ, জনগণের ধর্মীয় চেতনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত, জনগণের সমকালীন জীবনব্যবস্থা, শিক্ষার্থীর সমকালীন চাহিদা ও ভবিষ্যৎ, সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও জরুরি চাহিদাগুলো।
আধুনিক শিক্ষাক্রমের প্রবক্তা রালফ টেইলর ১৯৫৬ সালে শিক্ষাক্রমের একটি ধারণা দেন। এর মূল কথা হচ্ছে, ‘শিক্ষার্থীদের সব শিখন, যা শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিদ্যালয়ের দ্বারা পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয় তাই শিক্ষাক্রম।’ তিনি চারটি প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষাক্রমের ধারণাটি স্বচ্ছ করার চেষ্টা করেন। প্রশ্নগুলো হচ্ছে : ক. শিক্ষা কী কী উদ্দেশ্য অর্জন করবে; খ. কী কী শিখন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিদ্যালয় উল্লিখিত উদ্দেশ্য অর্জন করবে; গ. এসব শিখন অভিজ্ঞতা কী উপায়ে সংগঠন ও বিন্যাস করা যাবে; এবং ঘ. উদ্দেশ্যগুলো অর্জিত হয়েছে কি না, তা কীভাবে যাচাই করা যাবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, সংগঠন, মূল্যায়ন-এ চার স্তর মডেল বলা হয়ে থাকে টেলরের ধারণাকে। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) শিক্ষাক্রমের একটি ধারণা প্রদান করে। এতে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিজে নিজে পড়তে ও লিখতে পারে; তাই শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক ও বিভিন্ন সম্পূরক পঠন সামগ্রী থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ; কারণ যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষায় অভিজ্ঞতাই হচ্ছে শিখন ফল অর্জনের মূল। পাঠ্যপুস্তক সহায়ক হলেও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দক্ষতা, মূল্যবোধ, গুণাবলি ও চেতনা বিকাশের জন্য তাদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা ও হাতেকলমে কাজের মাধ্যমে যেতে হবে।
পাশাপাশি বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে শিশুদের সৃজনশীল চিন্তার সঠিক বিকাশ ও মূল্যায়ন করা যায়। শিল্প ও সংস্কৃতিতে শিখন-ক্ষেত্রটিকে এমন একটি সমন্বিত বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন সৃজনশীল ধারা চর্চার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী একজন নান্দনিক, রুচিশীল ও শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে ও জীবনযাপন করতে পারবে।
শিক্ষার্থীর ইচ্ছা ও প্রয়োজনবোধে সৃজনশীল সক্ষমতাকে উচ্চতর শিক্ষা, কর্মজগৎ বা আত্মনির্ভরশীল হতে বিবেচনা করারও সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন শ্রেণি এবং ৮১ জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে শিল্প ও সংস্কৃতিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সূত্রে তাদের অভিভাবকদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরিতেও শিল্পবোধকে কাজে লাগানোর চিন্তা করা হয়েছে।
১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত গড় শিখন ঘণ্টা ৭৯৯ এবং ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত গড় শিখন ঘণ্টা ৯১৯ ঘণ্টা। প্রচলিত ছুটির হিসাবকে বিবেচনায় রেখে মোট কর্মদিবস ১৮৫ দিন ধরা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শুক্র ও শনিবার দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে। দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষায় বর্তমানে ৩২ কর্মদিবস প্রয়োজন হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয় বিন্যাস ও মূল্যায়ন কৌশল পরিবর্তনের কারণে এ পরীক্ষা ৫ কর্মদিবসেই সম্পন্ন হবে।
প্রাথমিক স্তরে এ ক্ষেত্রে আরও সময় বেশি পাওয়া যাবে। তাছাড়া বর্তমানে দুটি সাময়িক পরীক্ষার জন্য ১২ কর্মদিবস করে মোট ২৪ কর্মদিবসের জায়গায় নতুন শিক্ষাক্রমে ৫ কর্মদিবস করে মোট ১০ কর্মদিবস প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস এবং বিজয় দিবস এই ৫টি জাতীয় দিবসের কার্যক্রম নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন সময়ের (বাহির) অন্তর্ভুক্ত বিধায় এখানে কর্মদিবস হিসেবে ধরা হয়েছে। ৮৯ ওইসিডি ও এর সহযোগী দেশগুলোর বাৎসরিক গড় স্কুল দিবস হল ১৮৫ দিন এবং ইউরোপিয়ান ২৩টি দেশের বাৎসরিক গড় স্কুল দিবস হল ১৮১ দিন।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে স্কুল কর্মদিবস বিভিন্ন, যেমন মেঘালয়ে ১৯২ দিন আবার মহারাষ্ট্রে ২০০ দিন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তাহে দু’দিন ছুটি হিসাব করে প্রস্তাবিত মোট কর্মদিবস ও শিখন ঘণ্টা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওইসিডি ও এর সহযোগী দেশগুলোয় গড়ে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা, গণিত ও শিল্পকলা বিষয়ে মোট শিখন সময়ের ৫২ শতাংশ সময় বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে মাতৃভাষা, বিদেশি ভাষা ও গণিত বিষয়ের জন্য মোট শিখন সময়ের ৪২ শতাংশ সময় বরাদ্দ থাকে।
২০২২ সালে নতুন পাঠক্রমের নতুন পাঠ্যবই পাবে প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। ২০২৩ সালে পাবে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এবং ২০২৪ সালে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। আর ২০২৪ সাল থেকেই মাধ্যমিকে কলা, মানবিক ও বিজ্ঞান নামে বিভাজন থাকছে না। কোনো কোনো শিক্ষাবিদ বলেছেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন না থাকায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ভাষা, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ও সাহিত্য সবই পড়তে হবে। মাধ্যমিক পাস করে একজন শিক্ষার্থী প্রায় সব রকমের জ্ঞান নিয়ে বের হবে।
বর্তমান পদ্ধতিতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা সাহিত্য বা সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিত না; আবার কলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও গণিতকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না এবং কাঁচাই থেকে যেত এসব বিষয়ে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিখনের সার্বিক উদ্দেশ্য বিশেষায়নের জন্য প্রস্তুতি; তাই নৈর্বাচনিক বিশেষায়িত বিষয়গুলোর জন্য এ স্তরে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
শিক্ষার্থী তার আগ্রহ, সামর্থ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনটি বিশেষায়িত বিষয় নির্বাচন করতে পারবে। জীবন ও জীবিকা শিখন ক্ষেত্রের আলোকে শিক্ষার্থীরা যেন আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ হয়; তার জন্য পেশাদারি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রায়োগিক বিষয়গুলো নির্বাচন করা যাবে।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন (১০০ শতাংশ), চতুর্থ থেকে পঞ্চম শিখনকালীন মূল্যায়ন (৭০ শতাংশ), সামষ্টিক মূল্যায়ন (৩০ শতাংশ), ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত (৬০ শতাংশ), সামষ্টিক মূল্যায়ন (৪০ শতাংশ)। নবম-দশম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন (৫০ শতাংশ), সামষ্টিক মূল্যায়ন (৫০ শতাংশ), একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন (৩০ শতাংশ), সামষ্টিক মূল্যায়ন (৭০ শতাংশ)। পাবলিক পরীক্ষায় ৩টি আবশ্যিক বিষয়ে ৩০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৭০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে।
বিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক সময়ে মাতৃভাষা, গণিত ও শিল্প-সংস্কৃতি শিখন ক্ষেত্রে শিশুদের অধিক সময় বরাদ্দ করা হয়েছে, যা প্রাক-প্রাথমিকে মোট স্কুল শিখন সময়ের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং প্রাথমিক স্তরে বাংলা, গণিত ও শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ে প্রায় ৫৬ শতাংশ শিখন সময় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯ম-১০ম শ্রেণিতে মোট শিখন সময়ের প্রায় ৪৫ শতাংশ সময় বরাদ্দ করা হয়েছে ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য।
বিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক সময়ে মাতৃভাষা, গণিত ও শিল্প-সংস্কৃতি শিখন ক্ষেত্রে শিশুদের অধিক সময় বরাদ্দ করা হয়েছে; যা প্রাক-প্রাথমিকে মোট স্কুল শিখন সময়ের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং প্রাথমিক স্তরে বাংলা, গণিত ও শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ে প্রায় ৫৬ শতাংশ শিখন সময় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯ম-১০ম শ্রেণিতে মোট শিখন সময়ের প্রায় ৪৫ শতাংশ সময় বরাদ্দ করা হয়েছে ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য।
মোটামুটি দশ বছর পরপর একটি দেশের কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। আমাদের বর্তমানে প্রচলিত কারিকুলামটি ২০১২ সালে চালু করা হয়েছিল। আবার ২০২২ সালে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম চালুর প্রস্তুতি চলছে। এ কারিকুলামের সঠিক বাস্তবায়ন আশা করছি।
মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত; সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক