ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয় জমে থাকা পরিষ্কার ও ময়লা দুই ধরনের পানিতেই এখনকার এডিস মশা ডিম পাড়তে সক্ষম শুধু সকাল ও সন্ধ্যায় নয় এখন এডিস মশা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই কামড়ায়
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। এর আগে ১৯৬৭ সালের দিকে ঢাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল। তখন তার নাম ছিল ঢাকা জ্বর (Dhaka Fever)। তবে ২০০০ সালের ডেঙ্গু কোনোমতেই ঢাকা জ্বরের ধারাবাহিকতা ছিল না। ডেঙ্গু জ্বরের আরেকটি নাম হলো ‘হাড্ডি ভাঙা জ্বর’। এই নামটি মূলত ইংরেজি ‘Bone Breaking Fever’-এর অনুবাদ। ডেঙ্গুর প্রধান দুটি লক্ষণ হচ্ছে- তীব্র জ্বর ও শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মনে হবে অসহনীয় ব্যথায় তার শরীরের হাড়গোড় যেন ভেঙে যাচ্ছে।
ডেঙ্গু একটি ভাইরাস জনিত রোগ। এই ভাইরাস এডিস মশার দ্বারা এক ব্যক্তি থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়ায়। এডিস মশা দুই ধরনের- এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টাই লোকালয়ে মানুষের বাড়িঘরে থাকে। এ জন্য এটিকে আবাসিক এডিস মশা বলা যেতে পারে। ঘর বা বাড়ির ভেতরে বিভিন্নভাবে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। অন্যদিকে এডিস অ্যালবোপিকটাস বা বুনো এডিস মশা ঝোপঝাড়ে থাকে। গাছের গর্তে, দুই ডালের মাঝের জায়গায় বা গাছের বড় পাতায় জমে থাকা পানিতে বুনো এডিস বংশ বিস্তার করে। সাধারণভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস আবাসিক এডিস দ্বারা ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু মহামারির সময়ে বুনো এডিস মশাও ডেঙ্গুর বাহকে রূপান্তরিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে ২০১৯-এর মহামারির পর বাংলাদেশে বুনো এডিস ডেঙ্গুর বাহকে রূপান্তরিত হয়েছে।
ডেঙ্গু জ্বর দুই ধরনের। একটা হচ্ছে ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু বা সাধারণ ডেঙ্গু এবং অন্যটি হলো হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরা ডেঙ্গু। ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণগুলো হচ্ছে- তীব্র জ্বর, মাথা, শরীর, হাড়ের জোড়া এবং অক্ষিগোলকে সুতীব্র ব্যথা। ডেঙ্গুতে শরীরে লাল ফুসকুড়ি, বমি ও বমি-বমি ভাব, খাবারে অরুচিসহ আরও কিছু উপসর্গ ও লক্ষণ থাকে। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুতে দাঁতের মাড়ি, কফ, বমি, মল-মুত্র ইত্যাদির সাথে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এ ছাড়া ডেঙ্গুতে রোগী জ্ঞান হারাতে অথবা জ্ঞান হারানোর পর্যায়ে চলে যেতে পারে। সে অবস্থাকে ডেঙ্গু শক অবস্থা (Dengue Shock Syndrome) বলা হয়। মহামারির সময়ে ডেঙ্গুর তিনটি ধরনই দেখতে পাওয়া যায়। রক্তক্ষরা ডেঙ্গু আক্রান্ত ও ডেঙ্গুর শক অবস্থায় রোগীর মৃত্যু বেশি হয়।
২০০০ সালের পর থেকে ২০২২ পর্যন্ত ডেঙ্গুর উপসর্গ, লক্ষণ ও চরিত্র কমবেশি একই রকম ছিল। কিন্তু এ বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর ধরনে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়। সারা বছর কমবেশি ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে যে-সব জায়গায় পানি জমে থাকে সেসব স্থানে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার বংশবিস্তার ঘটতে থাকে। আগে বলা হতো কেবলমাত্র জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে জমে থাকা পরিষ্কার ও ময়লা দুই ধরনের পানিতেই এখনকার এডিস মশা ডিম পাড়তে সক্ষম। এডিস মশার কামড়ানোর সময়ও বদলে গেছে। আগে এই মশা শুধু সকাল ও সন্ধ্যাবেলা মানুষকে কামড়াতো। কিন্তু এখন দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই কামড়ায়।
বেশি মাত্রার জ্বর (১০৪-১০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস), সারা শরীর ও অস্থিসন্ধিতে প্রচণ্ড ব্যথা, মাথা ও অক্ষিগোলকে তীব্র ব্যথা, গায়ে লাল ফুসকুড়ি ইত্যাদিকে ডেঙ্গুজ্বরের অন্যতম প্রধান লক্ষণ বলা হতো। এ বছর প্রচুর ডেঙ্গুরোগী পাওয়া যাচ্ছে যাদের শরীরে অল্প মাত্রার জ্বর থাকছে, আবার কারও কারও শরীরে জ্বর একেবারে নেই। কিন্তু তাদের পাতলা পায়খানা, বমি, মাথাঘোরা, অবসন্ন ভাব থাকছে। এই রোগিদের শরীরে দ্রুত পানি ও লবনশূন্যতা তৈরি হয়। ফলে তাদের রক্তচাপ কমে যেতে থাকে, কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে যায়, অস্থিরতা বাড়ে। এই রোগিদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। এ জন্য দেখা যাচ্ছে হাসপাতালে ভর্তি রোগিদের মধ্যে যারা মারা যাচ্ছে তাদের ৫০ ভাগের মতো ভর্তির প্রথম তিনদিনের মধ্যে মারা গিয়েছে। অতিরিক্ত ক্লান্ত ও অবসন্নভাব এবং ক্ষুধামন্দা নিয়ে কিছু রোগী চিকিৎসকের কাছে আসছে। পরীক্ষার পর জানা যায় তারা মূলত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। শিশুদের মধ্যেও ডেঙ্গুর চিরাচরিত উপসর্গের বদলে নানা ধরনের ভিন্ন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গুর এইসব বদলে যাওয়া উপসর্গ ও লক্ষণ দেখে লোকজন খুব বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ফলে রোগী এবং রোগীর স্বজনেরা চিকিৎসকের নিকট বা হাসপাতালে আসতে দেরি করে। এতে মৃত্যু বা আইসিইউ-তে ভর্তির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ইতোমধ্যে দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল রোগী ধারণ ক্ষমতার শেষ পর্যায়ে চলে গেছে। জুলাই মাসের প্রথম অর্ধেই অবস্থা এই পর্যায়ে উপনীত। বছরের প্রথম ছয়মাসে মৃত্যুর হিসাব অতীতের ষান্মাসিক রেকর্ড অতিক্রম করেছে। আমাদের দেশে ডেঙ্গুর পূর্ণ সময়কাল হচ্ছে জুলাই ও আগস্ট মাস। অর্থাৎ দুর্যোগপূর্ণ সময়ের অধিকাংশ এখনো সামনে রয়েছে। বর্তমান হারে ডেঙ্গু সংক্রমণ চলমান থাকলে সামনের দিনগুলোতে একটি ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা গত দুই যুগের সব পরিসংখ্যানকে অতিক্রম করতে পারে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো নিরাপদ ও কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ডেঙ্গুর ভয়ংকর থাবা থেকে রক্ষার প্রধান বর্ম হচ্ছে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করা। আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করে ডেঙ্গুর মতো মহামারির মোকাবিলা করা আমাদের দেশে কেন কোনো দেশেই সম্ভব নয়। মশা মারার দায়িত্ব হলো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের। সিটি করপোরেশনগুলো তাদের এই দায়িত্ব পালনে সফল হতে পারেনি। তাদের ব্যর্থতার কারণে ঢাকা মহানগর থেকে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রামক মহামারি নিয়ন্ত্রণের কাজে সফলতার প্রথম শর্ত হলো জনসাধারণকে যুক্ত করে কর্মধারা পরিচালনা করা। আমাদের স্থানীয় সরকার পরিষদ এই কাজটি করার ন্যূনতম কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে বিগত দুই যুগে বাগাড়ম্বর হয়েছে অনেক, কিছু মশা নিয়ন্ত্রণে এতটুকুও সাফল্য আসেনি।
একটি ভয়ংকর কালান্তক চেহারা নিয়ে এ বছরের ডেঙ্গু আবির্ভূত হয়েছে। সাধারণ মানুষ, স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা স্থানীয় সরকার পরিষদ যদি একটি সমন্বিত ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ সারা দেশে যুগপৎ বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলেই কেবল ডেঙ্গুর ভয়াবহ অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটা করতে ব্যর্থ হলে বিপুল জীবনহানি, অসংখ্য মানুষের স্বাস্থ্যহানি ও অপরিমেয় সম্পদহানি দিয়ে ব্যর্থতার দায় শোধ করতে হবে।
লেলিন চৌধুরী: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ