একটা সময় ছিল যখন নারীরা চার দেয়ালে বন্দি ছিল। সেসব এখন অতীত। যদিও নারীদের জন্য পথটা এখনো মসৃণ নয়। বহু বিচিত্র বাধার মুখে তাঁরা পড়ছেন হরহামেশা। বাংলাদেশের মতো দেশে এসব বাধা আবার তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু তাতে কী হবে? নারীরা এখন নিয়মিতই সাফল্যের জয়গাথা লিখছেন। এই সাফল্য কখনো কখনো বিশ্বকেও চমকে দিচ্ছেন, নিজের সাথে সাথে মাথা উঁচু করছেন দেশেরও।
বছরজুড়েই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থেকেছেন নারীরা। নিজের কাজ দিয়ে, সাফল্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। নারীরা প্রমাণ করছেন, ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসম্ভবকেও জয় করা যায়। প্রতিবারের মতো এ বছরও নানা ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে আলোচনায় ছিলেন নারীরা। আসুন জেনে নেওয়া যাক নারীদের কিছু অর্জনের কথা
সেঁজুতি সাহা এবং ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী
এ বছর এশিয়ার সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় জায়গা করে নেন বাংলাদেশের দুই নারী বিজ্ঞানী। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাময়িকী ‘এশিয়ান সায়েন্টিস্ট’–এর সেরা এশীয় বিজ্ঞানীদের তালিকায় ওঠে তাঁদের নাম। তাঁরা হলেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী ও বাংলাদেশের চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) অণুজীব বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা।
গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী প্লাস্টিকের দূষণ এবং প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। গাউসিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পর ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ থেকে পিএইচডি করেন। তিনি উপকূলীয় নারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির একটি গবেষণা দলেও কাজ করেন তিনি। তিনি আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা ওয়াইল্ডটিমের বোর্ড সদস্য। ২০২২ সালে জলজ প্রতিবেশ এবং বিপন্ন প্রাণী সুরক্ষায় অবদানের জন্য ওডব্লিউএসডি-এলসিভিয়ার ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা ‘লাইফ সায়েন্সে’ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণায় সমতা লাভে অন্যতম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ভূমিকা রাখছেন এই অণুজীব বিজ্ঞানী। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) পরিচালক সেঁজুতি। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম করোনাভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন করেন। তিনিই বিশ্বে প্রথম প্রমাণ করেন, চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শুধু রক্ত নয়, শিশুর মস্তিষ্কেও বিস্তার লাভ করতে পারে।
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি। তিনি এ বছর বিবিসির তালিকাভুক্ত বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীদের একজন। ২৬ বছর আগে চুলার আগুনে থমকে গিয়েছিল তাঁর স্বাভাবিক চলাফেরার শক্তি। তবুও তিনি থেমে ছিলেন না। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী। আইভির জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনায়। খুলনার গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল, খুলনা বিএল কলেজে পড়ালেখা করেন। এরপর ইডেন মহিলা কলেজ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন শিক্ষায় স্নাতকোত্তর করেন। তিনি ২০১৪ সালে প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ের জন্য গড়ে তোলেন ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’ নামে এক প্রতিষ্ঠান। আইভি এ পর্যন্ত পাঁচটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর লেখা তিনটি উপন্যাসও ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। ২০২৬ সালে তিনি ‘নীরবে’ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে সম্মাননা পান
তৌহিদা শিরোপা
এ বছর ভোগ বিজনেসের ১০০ উদ্ভাবকদের তালিকায় ‘সাস্টেইনেবিলিটি থট লিডার’ ক্যাটাগরিতে সম্মাননা পান বাংলাদেশি তৌহিদা শিরোপা। তিনি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’–এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি শুধু ‘মনের বন্ধু’র প্রতিষ্ঠাতাই নন, তিনি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিশেষ করে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও পরিপূর্ণ সুস্থতা নিশ্চিতের কাজে একজন অগ্রদূত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। ২০১৬ সালে যাত্রালগ্ন থেকেই ‘মনের বন্ধু’ পোশাক শ্রমিক, নারী ও তরুণদের জন্য সাশ্রয়ী এবং সুলভ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে।
জাহ্নবী রহমান
২০২৩ সালের ফোর্বসের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ ক্যাটাগরিতে এশিয়া অঞ্চলের উদীয়মান তরুণের তালিকায় স্থান করে নেন জাহ্নবী রহমান। জাহ্নবী কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকোত্তর করেন। তিনি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন; নাম—‘রিলাক্সি’। ‘রিলাক্সি’ মানুষের মুড বা মনের ভাব বুঝতে বিনামূল্যে চেক-ইন ও মেডিটেশনের সুযোগ দেয়। এ ছাড়া গ্রাহকদের চাহিদামত অর্থের বিনিময়ে ভার্চুয়াল থেরাপির ব্যবস্থা করে ‘রিলাক্সি’। তিনি ফেসবুক পেজ ও অ্যাপ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করে তুলছেন। এ ছাড়া আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির জন্য ফিজিক্যাল হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস ক্লিনিকের (পিএইচডব্লিউসি) সঙ্গে পার্টনারশিপে কাজ করছে ‘রিলাক্সি’।
নাজলী হোসেন
এ বছর এশিয়ার শীর্ষ ১০ নারী স্থপতির তালিকায় স্থান পান বাংলাদেশের নাজলী হোসেন। ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় পত্রিকা ‘উইমেন অন্ট্রাপ্রেনার ইন্ডিয়া’ এই সম্মাননা দেয়। ২০০৭ সালে বুয়েট থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন নাজলী হোসেন। তিনি বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব ভবন নকশার পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের স্থপতি তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করার প্রায় এক যুগ পর নাজলী হোসেন জায়গা করে নেন এশিয়ার শীর্ষ ১০ নারী স্থপতির তালিকায়।
রূপালী চৌধুরী
টাইম ম্যাগাজিনের চলতি বছরের প্রথম সংখ্যায় (জানুয়ারি) জায়গা করে নেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পেইন্টস সল্যুশন ব্র্যান্ড বার্জারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশে প্রথম নারী হিসেবে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। রূপালী চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইম সাময়িকীর পাতায় বাংলাদেশের পেইন্টস ইন্ডাস্ট্রির প্রবৃদ্ধি এবং মার্কেট লিডার হিসেবে বার্জারের ভূমিকা নিয়ে তথ্যবহুল আলোচনা উপস্থাপন করেন। একজন সফল বিজনেস লিডার হিসেবে টাইম ম্যাগাজিনের পাতায় নিজের মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরার সম্মান অর্জন করেন তিনি। রূপালী চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়ায়। ১৯৮৪ সালে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। এরপর যুক্ত হন বার্জারে।
মনীষা দাস চৈতী
এ বছর নাসার পুরস্কার পান বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মনীষা দাস চৈতী। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা থেকে তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত ‘ল্যান্ডস্যাট ক্যালিব্রেশন/ভ্যালিডেশন’ দলের হয়ে রবার্ট এইচ গডার্ড পুরস্কার পান তিনি। মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এ পুরস্কারকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার তাত্তাকান্দা গ্রামের মেয়ে মনীষা দাস চৈতী। তাঁর বেড়ে ওঠা নরসিংদী শহরে। মনীষা পড়ালেখা করেন খুলনা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিতে (কুয়েটে)।
ড. রুম্মান চৌধুরী
এ বছর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশ্বসেরা ১০০ জনের নাম ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন টাইম। এই তালিকায় স্থান পান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড. রুম্মান চৌধুরী। রুম্মান ডেটা সায়েন্স ও সোশ্যাল সায়েন্সের সমন্বয়ে ‘অ্যাপ্লাইড অ্যালগোরিদমিক এথিকস’ নিয়ে কাজ করেন। তিনি মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিকতা ও মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করেন।
রুম্মান চৌধুরী ১৯৮০ সালে নিউইয়র্কের রকল্যান্ড কাউন্টিতে জন্ম নেন। তিনি ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স ও পলিটিক্যাল সায়েন্স বিষয়ে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে স্নাতক পাস করেন। এরপর তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড কোয়ানটিটেটিভ মেথডস বিষয়ের ওপর এমএসসি ডিগ্রি নেন। তিনি সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করার পাশাপাশি সান ডিয়েগোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পিএইচডি করেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি টুইটারের (বর্তমানে এক্স) একটি দলের প্রকৌশল পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এ সময় তিনি টুইটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নৈতিকতার মানদণ্ডের সমন্বয় ঘটানোর জন্য কাজ করেন।