২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ২:২৭
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ২:২৭

রিপ্রেজেন্টেটিভ কথন

পুরোই লাগামছাড়া এখন ওষুধ কোম্পানী। ও মার্কেটপ্লেসে কাজ করা কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ বাহিনী! কোম্পানী শুধু ওষুধ উৎপাদনই করছে না। ওষুধ বাণিজ্যের প্রতিযোগিতার নামে চলছে রীতিমত, এদের কাষ্টমার যুদ্ধ ! দেশের আনাচে কানাচে, অলি গলি, সবখানেই ওষুধ শিল্পের প্রচার প্রসারে কাজ করছে বিক্রয় প্রতিনিধিরা। বলতে গেলে, কোম্পানীর কোর্ট প্যান্ট গায়ে ভদ্রলোকদের আনাগোনায় ধন্য হচ্ছে মেডিকেল পাড়া! প্রতিটা মহল্লা মহল্লায় কাঁধে বাহারী ব্যাগ ঝুঁলিয়ে ওষুধের দোকান-ফার্মেসীতে এই মানুষদের রাজত্য! এই শ্রেণীজীবিদের আমরা ইংরেজীতে- ‘রিপ্রেজেন্টিভ’ বলতেই বেশি অভ্যস্ত।

ফার্মেসী থেকে হাসপাতাল, কিংবা প্রাইভেট ক্লিনিক। অথবা এলাকার ভেতরে যে কোন ডাক্তারের চেম্বার। সবখানেই তাদের ছুটোছুটি। পথে-ঘাটে এখন প্রচুর পরিমাণে রিপ্রেজেন্টিভদের নামী দামী মটরসাইকেলও দেখা যায়। এত দামের জিনিস ওষুধ কোম্পানী তাদেরকে উপহার হিসেবেও দিচ্ছে। আবার অনেক কোম্পানী ওষুধ বিক্রির টার্গেটের কমিশনসরূপও দিচ্ছে এসব গিফট। ডাক্তার ভিজিট ও ওষুধ সেল বিষয়ক কাজ নিয়েই রোজ তাদের ফিটফাট হয়ে চলতে হয়। চাকরির পর পরই একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ ওষুধের স্যাম্পল, আকর্ষণীয় ডাক্তারি প্যাড, স্লিপ প্যাড, নোটবুক, ক্যালেন্ডার, দামী কলমসহ বাহারী উপহার সামগ্রী নিয়ে বের হয়। সবাইকে ছুটতে হয় ডাক্তারদের চেম্বারে চেম্বারে। যে কোন ওষুধের ফার্মেসীতে বা ক্লিনিকে ডাক্তারের চেম্বারে গেলেই এই মানুষগুলোর ভীড় দেখা যায়। প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হবে। অনেক সময় অবাকও হতে হয়। দেখে হয়ত অনেকে মনে করতে পারে, আজ এত রোগি এসেছে? অথচ একটু পরই টের পাওয়া যায়। না। এখানে রোগির চেয়ে ওষুধ কোম্পানীর লোক বেশি! এই সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আগে একটা ওষুধ কোম্পানীতে শুধুমাত্র বিজ্ঞান শাখা থেকে যারা লেখাপড়া করেছে, তাদের নিয়োগ দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে এসব নিয়ম কানুনের কোন আমল নেই। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং দেখতে সুদর্শন হলেই ব্যস! অথবা দেদার মুখ বেঁচে কোম্পানীর ওষুধ বিক্রির ক্ষমতা রাখলেই চলে। আর মালিক মহলের নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে আসলে তো সেখানে ‘রিপ্রেজেন্টিভ’ হিসেবে থাকছে অগ্রাধিকার। তাই এই পদধারীদের যোগ্যতা নিয়ে আপাততঃ কথা নাইবা বললাম।

ওষুধ বিক্রিতে এরা পারদর্শী কিনা? চিকিৎসককে ম্যানেজ করে রোগীকে নিজস্ব কোম্পানীর ওষুধ লেখাতে পারঙ্গম কিনা? এই যদি হয় ওষুধ কোম্পানীর নীতি! সেখানে অভিযোগ নিউজ বিডি’র কাছে তো সাধারণ মানুষের অভিযোগ আসাটাই স্বাভাবিক। শাহবাগ মোড়ে একটি ওষুধের দোকানের সামনে ইসলমাইল নামের একজন মুরুব্বী বঙ্গবন্ধু মেডিকেল থেকে ওষুধ নিতে এসে জানালেন; “ডাক্তার আর ওষুধের দোকানদার এখন আর রোগি দেখলে খুশী হয় না। এরা বেশি খুশি হয় ওষুধ কোম্পানীর লোক দেখলে!’ এই ক্ষোভটা অনুভব করতেই এগিয়ে যাই আরও কয়েকটা স্পটে। এমন একটা ওষুধের দোকান ও চেম্বার মেলেনি যেখানে রিপ্রেজেন্টেটিভহীন ছিল ! একটা বড় ওষুধের দোকানে দাঁড়ানো রাতুল নামের এক লোক বলল; ‘আমি দশ মিনিট ধরে ওষুধের দোকানে দাঁড়িয়ে। প্রেসক্রিপশন হাতে চিল্লাচিল্লি করছি। আমার ছেলের ডেঙ্গু। তার স্যালাইন লাগবে। একজন স্যালাইন পুস করার লোক দিতে পারবে কিনা জানতে আসলাম? দোকানদার আমলই দেয় না দেখেন। আর কোম্পানীর একজন হোন্ডা থামায়া উঁকি মারল… কি বলল জানি না। ঔ যে দেখেন, কর্মচারীগুলা কিভাবে শুধু ওষুধের তাক তল্লাসী করছে? সন্ধ্যার পর জনৈক ভদ্রমহিলারও একই অভিযোগ; ‘‘ আমার মেয়েটার আজ কয়দিন ধরে জ্বর। ওই যে ওষুধের দোকানের চেম্বারটা দেখেন। ডাক্তারের কাছে রোগীরা কত কষ্ট করে সিরিয়াল ধরে বসা। আর বাইরে দেখেন কয়টা হোন্ডা। এই দোকানদাররা সিরিয়াস রোগীকে আগে ভিতরে যেতে না দিয়ে, কোম্পানীর লোকদের দেখেন কিভাবে ঢুকাচ্ছে!

ঠিক সন্ধ্যার পর থেকেই মূলতঃ বড় বড় ডাক্তার সাহেবরা বিভিন্ন চেম্বারে সময় দেন। অনেক ডাক্তার আবার সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি দুটি চেম্বারেও গিয়ে রোগি দেখে থাকেন। স্বভাবতই তাই রোগির সিরিয়ালের ভিড় লেগে যায়। চিকিৎসকের এই নির্ধারিত সময় থেকেই কিন্তু বসে থাকা রোগিও দেখতে হয়। আবার বিভিন্ন কোম্পানী থেকে আসা রিপ্রেজেন্টেটিভ কেও সময় দিতে হয়। ডাক্তারদের এখানে পড়তে হয় গ্যাড়াকলে। একই ওষুধ। ধরুন প্যারাসিটমল। অথবা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। দশ কোম্পানীর লোক এসে বলছে, স্যার আমাদেরটা ভাল। ডাক্তার মহাশয় এখন কি করবেন? কোন রিপ্রেজেন্টেটিভকে প্রাধান্য দেবেন? কোন ওষুধকে বলবেন- ওয়ান অফ দ্য বেস্ট? ডাক্তারি বিদ্যাও এখন খুব বিপদের মধ্যে কাবু হয়ে আছে! রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়ে শুধু রোগিই বিরক্ত হচ্ছে না। স্বয়ং চিকিৎসকেরও অনেক সময় হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশে! উনাকে যেমন রোগি দেখতে হবে। আবার রোগির জন্য বাজারে আসা নতুন ওষুধ সম্পর্কে রিপ্রেজেন্টেটিভ থেকেই ‘এডভার্টাইজ’ শুনতে হবে! চেম্বারগুলোর ভিতর-বাহিরে সে কারণেই এখন ঠাসা থাকে রিপ্রেজেন্টেটিভে। যারা ডাক্তারের সিরিয়াল পান। রোগির কথা বলছি না। স্যারের সাথে কথা দেখা করে, এভারেস্ট জয় করার আনন্দ দেখবেন, কোম্পানীর এই মানুষগুলোর। জানতে চাই এমনই একজন ওষুধ কোম্পানীর ভাইয়ের কাছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক রিপ্রেজেন্টেটিভ জানালেন; রোগিদের ভিড়ে এসে, সুযোগ বুঝে স্যারদের রুমে ঢুকে পড়তে হয়। বুঝি রোগিরা বিরক্ত হন। কিন্তু ভাই এটাই আমাদের কাজ।’’ ডাক্তারকে ওষুধের গুনাগুন বুঝানো তো বড় কথা নয়, ঔ কোম্পানীর ওষুধ রোগিকে যেন প্রেসক্রিপ করা হয়, সে জন্যই মূলতঃ কোম্পানীর সুবোধ মানুষগুলার নিত্য পরিশ্রম। শুধু ওষুধের রিপ্রেজেন্টেটিভরাই না, বিভিন্ন নামী দামী ডায়াগনেস্টিক প্রতিষ্ঠানের রিপ্রেজেন্টেটিভও দিন রাত শহরের বিভিন্ন ডাক্তার চেম্বারে ভিজিট করছে। অনেক চিকিৎসক আছেন আবার সম্পুর্ণ ভিন্ন। কোম্পানীর কথায় কথা আমলে নেন না। নিজের মেধা ও রোগির রোগ বিবেচনা করেই সাজেস্ট করেন। প্রকৃতপক্ষে এটাই করা উচিত। তাজুদ্দিন নামক জনৈক ভদ্রলোক বললেন; “আমার আম্মাকে নিয়ে আসছি একটা ক্লিনিক থেকে এমআর করাব। লিফটে ওঠব। ওমা! কয়েক রিপ্রেজেন্টেটিভ আমাদের ঘিরে ধরল। আমার মায়ের প্রেসক্রিপশন ও টেস্টের কাগজটা নাকি একটু দেখবে। আমি এম্বুলেন্স ভাড়া করে রোগি নিয়ে আসছি। এই রোগিকে আবার ক্লিনিকে নিয়ে যাব। এমনেই তাড়াহুড়া। এদিকে এরা করছে জ্বালাতন। এমন বিরক্ত যে বলার না ভাই।’’ সোহেল নামেরও এক যুবক এসেছে, তার মাকে নিয়ে একটা ক্লিনিকে। ওর মা স্লিপ খেয়ে পড়ে গিয়ে মেরুদন্ডে আঘাত পেয়েছে। ও বলল; ‘‘ ডাক্তার দেখায়া বের হইছি। রিপ্রেজেন্টেটিভ কয়জন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখতে চাইলো। দিলাম। তারা ছবি তুলে নিলো। বললাম, কি করবেন। বলে, কাজ আছে। আপনারা বুঝবেন না।’’ আরেকজন আপা আক্ষেপের সুর ধরেই বললেন, “ডাক্তার আর রিপ্রেজেন্টেটিভ এই দুই পেশাজীবিরা সঠিক মনোযোগটা যদি রোগির রোগের প্রতি ইনভেস্ট করত। তাহলে রোগির ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকা লাগত না। এমন অনেকও বড় বড় ক্লিনিক আছে। রোগি ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে পেতে রাত ১ টাওবেজে যায়। অনেক সময় রাগি ডাক্তার রাত হলে ঐদিন আর রোগি দেখেনও না। অথচ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ কিন্তু ফুস করে ফুস্কি মেরে দেখবেন কোন ফাঁক দিয়ে চলে গেল?” এই সমালোচনা আসলে কতটা সাধারণ মানুষ মেনে নেবে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কাছে রোগি ছাড়া ওষুধ কোম্পানীর লোকদের জন্যই একটা আলাদা দিন ধার্য করা উচিত। যেদিন কোন রোগিই আসবে না। শুধু ওষুধের স্যাম্পল নিয়ে রিপ্রেজেন্টেটিভ আসবে। প্রাণভরে কোম্পানীর ওষুধের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে যাবে!

আমরা এই পেশাগত কাজের মানুষদের বিরোধিতা করছি না। কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ সবাই ফিটফাট থাকে। দেখতে বেশ ভালই লাগে। সংসারের প্রয়োজনেই তো সবাই কর্ম করে খাচ্ছে। বরং এতে বিপুল শ্রেণীর বেকার যুবকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। এখন প্রয়োজন শুধু এই পেশার লোকের সঠিক নির্দেশনা। ওষুধ বিক্রির ক্যানভাসের আগে সর্বাগ্রে রোগিদের চিকিৎসা সেবার সুযোগ দিতে হবে। ডাক্তারের চেম্বারে ডাক্তার ভিজিটের নামে সিরিয়ালে বসে থাকা মানুষগুলার সাথে করা চলবে না ছলচাতুরি। রোগির প্রতি সহনশীল ও সচেতন থাকার গুরু দায়িত্বটি এখন কোন ক্লিনিক অথবা ওষুধের ফার্মেসীর মালিক শ্রেণীর। ডাক্তার, রোগি ও ওষুধ। এই তিনে মিলেই কিন্তু মানুষের সুস্থ থাকা। ফার্মেসী, ডাক্তার ও রিপ্রেজেন্টেটিভ সবাই হোউক রোগির শুভাকাঙ্খি। এই মেলবন্ধনেই শুধু দুর হতে পারে- যত সব সমালোচনা।

মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি
ছবিঃ প্রতিবেদক

Facebook
Twitter
LinkedIn