বইমেলার দিনলিপি
বইমেলা শুক্রবার ছিল জনজোয়ার। বইয়ের তালিকার হিসেবে মেলার ৩য় দিন থেকে এ পর্যন্ত নতুন বই বেরিয়েছে ৬৩৮ টি। গতকাল ৯ ফেব্রুয়ারি নতুন বইয়ের ছিল রেকর্ডদিন। এই পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৭১ টি বই এসেছে এই দিন। যতই দিন যায় বই’ও বাড়ছেই। বাড়ছে লেখকমেলা। পাঠক ও মেলার দর্শনার্থী। গত বৃহস্পতিবার ছিল মেলার ৮তম দিন। এদিন বিকেল ৪:০০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ : আহমদ শরীফ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজীব সরকার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মোরশেদ শফিউল হাসান এবং আহমদ শরীফকে নিয়ে একটি মহামূল্যবান গ্রন্থের গবেষকলেখক আফজালুল বাসার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী। প্রাবন্ধিক বলেন, শিক্ষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সমাজ রূপান্তরকামী বুদ্ধিজীবী-বহুমাত্রিক পরিচয়ে ভূষিত আহমদ শরীফ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিন্তাবিদ। রেনেসাঁর প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। আহমদ শরীফের ইহজাগতিক জীবনদর্শনের মূলে কাজ করেছে রেনেসাঁস চেতনা। মানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর ব্রত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির অবিচল অনুশীলন করেছিলেন তিনি। এ জন্য স্বাধীন মত প্রকাশ করা থেকে নিজে কখনো বিরত থাকেননি। আহমদ শরীফের জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে যুুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা, মানবমুখিনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও আধুনিকতার উজ্জ্বল সম্মিলন দৃশ্যমান হয়।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বিংশ শতাব্দীর একজন আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। তিনি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ নিয়ে মৌলিকভাবে গবেষণা করেছেন। গভীর অনুসন্ধিৎসা ও জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। জ্ঞানের আড়ষ্টতা ছাড়িয়ে জ্ঞানের গতিশীলতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়েছেন তিনি। বস্তুবাদী ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আহমদ শরীফ সমাজ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটানোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, অধ্যাপক আহমদ শরীফের চিন্তাজগৎ ছিল সুদূর প্রসারিত। জ্ঞান অন্বেষণের ধারাবাহিকতায় তাঁর চিন্তাজগতে বিবর্তনও ঘটেছে। নতুন বিষয়কে সহজভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। এই মহান চিন্তকের ইহজাগতিক ও রেনেসাঁ-চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক। আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন শিশুসাহিত্যিক দীপু মাহমুদ, গবেষক আলী আকবর টাবী, কবি সুমন সরদার এবং কথাসাহিত্যিক শাহরিয়া দিনা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি আশরাফ আহমদ, নাসরীন জাহান, কামরুল হাসান এবং আলফ্রেড খোকন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মাহিদুল ইসলাম, শাকিলা মতিন মৃদুলা এবং অতনু করঞ্জাই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুথি পাঠ করেন মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম। এছাড়াও ছিল এ. কে. আজাদের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আনন্দন’ এবং শাহাবুদ্দিন আহমেদ দোলনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সুর সুধা সংগীতায়ন’-এর পরিবেশনা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী আকরামুল ইসলাম, আবুবকর সিদ্দিক, দেলোয়ার হোসেন বয়াতি, আমজাদ দেওয়ান, লাভলী দেব এবং আবদুল আউয়াল। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন তুলসী সাহা (তবলা), সুমন রেজা খান (কী-বোর্ড), মো. মনিরুজ্জামান (বাঁশি) এবং শাহরাজ চৌধুরী তপন (গীটার)। এবং গতকাল বইমেলার ৯ম দিন কিন্তু বইমেলা নবম দিন। মেলা শুরু হয় সকাল ১১ টায় এবং মেলা চলেছে রাত ৯ টা পর্যন্ত। সকাল ১১ টা থেকে বেলা দুপুর ১ টা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর। শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা : অমর একুশে উদ্যাপনের অংশ হিসেবে সকাল ৮:৩০মিনিটে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এতে ক-শাখায় ৩৯৫, খ-শাখায় ২৩৫ এবং গ-শাখায় ৬৫ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন অধ্যাপক নিসার হোসেন। শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা : সকাল ৯:৩০মিনিটে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক-শাখায় ১২৩, খ-শাখায় ১৩৮ এবং গ-শাখায় ৫১ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন বাচিকশিল্পী আনজুমান আরা, মো. গোলাম সারোয়ার এবং রফিকুল ইসলাম। বিকেল ৪ টায় যথাক্রমে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ : এস. ওয়াজেদ আলি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ইকতিয়ার চৌধুরী এবং কুদরত-ই-হুদা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন। প্রাবন্ধিক বলেন, এস. ওয়াজেদ আলির রচনাসমগ্র কালের স্থুল ও নির্মম মুখোশমালা খুলে দেওয়া, সর্বমানবের মাঙ্গলিক সমাজ নির্মাণের ইশতিহার। স্নায়ু ও মজ্জার ভেতর আশ্চর্য বরাভয় নিয়ে তিনি লিখেছেন সমাজ-রাষ্ট্র-জীবন ও শিল্পসন্ধানী মানবমুক্তির দুঃসাহসিক রচনাসমূহ। এস. ওয়াজেদ আলির রক্ত ও মজ্জায় গেঁথে ছিল স্বদেশিকতা, জাতিত্ববোধ, মানবসম্পর্কের ঔদার্য। এমনকি তাঁর সাহিত্য ও নন্দনচিন্তার সাঁকো গড়ে উঠেছে মানুষের মাঙ্গলিক সম্মিলনের আকাক্সক্ষায়। কালের ক্ষত, রক্তের দাগ এবং অগ্নিদগ্ধ ছাই পেরিয়ে যে অখন্ড রাষ্ট্রের স্বপ্ন তিনি দেখেছেন, স্বভাবতই সেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আলোচকবৃন্দ বলেন, স্বচ্ছল ও অভিজাত বাঙালি মুসলমান পরিবারের সন্তান এস. ওয়াজেদ আলি ইউরোপীয় আধুনিক চিন্তা-চেতনার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। ধর্মচর্চার ব্যাপারে এস. ওয়াজেদ আলি ছিলেন যুক্তিবাদী, আধুনিক ও উদার দৃষ্টিসম্পন্ন। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের চাইতে অনেক অগ্রসর। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন, এস. ওয়াজেদ আলি ছিলেন সব্যসাচী লেখক এবং একজন মহান চিন্তক। আন্তঃসাংস্কৃতিক মিলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তাঁর আদর্শ ও চিন্তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য আমাদের যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
নিয়মিত অনুষ্ঠানের প্রাণ ছিল- লেখক বলছি অনুষ্ঠাটি। প্রতিবেদনের ক্যপসনে লেখক উপস্থাপক ইউরুল ইউসুফের পোষ্ট থেকে নেয়া চিত্রটিই বলে দিচ্ছে সে কথা। এই প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন শিশুসাহিত্যিক রিফাত নিগার শাপলা, গবেষক অধ্যাপক মো. মাহবুবর রহমান, কবি মাশরুরা লাকী এবং কথাসাহিত্যিক আনোয়ার হোসেন বাদল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি হারিসুল হক, বায়তুল্লাহ কাদেরী এবং আফরোজা সোমা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আজহারুল হক আজাদ, সৈয়দ শহিদুল ইসলাম, সুকান্ত গুপ্ত এবং তামান্না সারোয়ার নীপা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুথি পাঠ করেন আবুল বাশার তালুকদার। এছাড়াও ছিল মো. বশির উদ্দিন মাহমুদের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিশ্বভরা প্রাণ’, সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শ্রুতি সিলেট’ এবং ড. লীনা তাপসী খানের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন International Center Bengali Music (ICBM)-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী অণিমা মুক্তি গোমেজ, মমতা দাসী, শামসেল হক চিশতি, রওশন আলম, বাউল সুভাষ বিশ্বাস, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ওয়াদুদুর রহমান রাহুল এবং ফারুক নূরী। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন রাজু চৌধুরী (তবলা), রবিনস্ চৌধুরী (কী-বোর্ড), মো. ফায়জুর রহমান (বাঁশি), অরূপ কুমার শীল (দোতারা) এবং আব্দুস সোবহান (বাংলা ঢোল)। আজ একুশে বইমেলার ১০ দিন। শনিবার। ছুটিদিন আছে। যথারীতি সকাল ১১ টা থেকেই কিন্তু বইমেলা উন্মুক্ত আছে সবার জন্য। সাথে আছে বইমেলার মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান সূচী। নিজের বাড়ির ব্যক্তিগত পাঠাগার সমৃদ্ধ করতে আর বিলম্ব নয় । দেখে বেছে পড়ার মতো বই সংগ্রহে ভাষার মাসটি সত্যি অতুলনীয়। বইমেলা থেকে বই খুঁজে নেয়ার মতো এত সহজ বছরে এত সহজে কখনও আসবে না পাঠক।
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি
তথ্যসেবাঃ সমীর কুমার সরকার, পরিচালক
জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগ, বাংলা একাডেমি।