বইমেলার দিনলিপি
আজ নতুন বই এসেছে ১১৫টি। বইমেলার বড় নামি স্টলের দিকে নজর থাকে পাঠকের। কারণটা বই সংগ্রহ ও প্রকাশনা নয়। পাঠককে দেখার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করা। এই শোভায় কম বেশি সব প্রকাশকেরই মেলার শুরু থেকেই বই সাজানোর আগে নিজেদের স্টল সুন্দর সুনিপনের দিকেই ঝোঁক দেখা গেছে। বাংলা একাডেমর লিটলম্যাগ চত্বর সব বড়সড় পাঠকের ভিড়ে তাই খুব এতিমের বেশেই দেখা যাচ্ছে। লিটল ম্যাগানি লেখকের শোনিত হাতিয়ার। পৃথিবীর সব পাঠক হৃদয় কাঁপানো সাহিত্যিকের প্রধান ও প্রথম ভালোবাসার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন। আমাদের অনেক সাহিত্যিকও এই লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে লেখা শুরু করেছেন। বইমেলা তো চলে যাবে মাস শেষে। এই লিটল ম্যাগাজিনই কিন্তু বারোটি মাস তাদের সাহিত্য সেবায় পাঠক লেখককে এক সুঁতোয় ধরে রাখবে। কথাগুলো বলা মানে, এবারের বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে বাঁশ দিয়ে খুঁটি গেরে দায়সারা ভাবে ছোট পরিসরের প্রকাশনাগুলোকে খুব বেমানানই দেখাচ্ছে। আর একটু হাত প্রসারিত নজর আনলে হয়ত লিটল ম্যাগের স্টল গুলো হতো আরও ব্যতিক্রমী সুন্দর! ভাল ভাল স্টল ঘুরে ঘুরে বই পাঠকের এমন দিনহীন লিটল ম্যাগাজিন কোনদিনও কাম্য হতে পারে না। আগামির জন্য এই বিষয়টা থাকল তুলে রাখা। সাদা কাপড়, বাঁশ ও পলিথিনের এই চিরাচরিত বইয়ের ছোট্ট লিটলম্যাগ স্টল আর কতজীবন?
আসি গতকালের বইলোর অনুষ্ঠানে। কাল ১২ তম দিন চলে গেলো। মেলায় বই বেরিয়েছে ১১৫ টি। বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি : হেনা দাস শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জোবাইদা নাসরীন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঝর্না রহমান এবং ফওজিয়া মোসলেম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার। প্রাবন্ধিক বলেন, ‘হেনা দাস আজন্ম এক প্রতিবাদী সত্তাÑএকজন শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, ঈর্ষণীয় সংগঠক। নির্লোভ শুভ্রতার প্রদীপ হয়েই তিনি আলো ছড়িয়েছেন এবং সকল প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে মানুষের জন্য পথ উন্মোচন করেছেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং শোষণমুক্তির লক্ষ্যে একজন সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। এজন্য ঔপনিবেশিক শাসন, শ্রেণি ও লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। মহিলা সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, গণনাট্য সংঘ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হেনা দাস নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন’। আলোচকবৃন্দ বলেন, ‘বিপ্লবী হেনা দাস ছাত্রজীবন থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। নারী আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মানুষের মধ্যে থেকে আজীবন তিনি বিপন্ন মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। কোনো বাধাই তাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সব বাধা উপেক্ষা করে দৃঢ়চিত্তে নিজের আদর্শের পথে অগ্রসর হয়েছেন হেনা দাস। বিপ্লবী চেতনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন সৃজনশীল মননের অধিকারী একজন মানুষ’। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক শিরীণ আখতার বলেন, ‘বিপ্লবী হেনা দাস অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন সারাটি জীবন। তাঁর প্রতিটি কাজে দৃঢ় মনোবল ও সংগ্রামী আদর্শের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। আমাদের জীবনে, মননে এবং সুন্দর সমাজ গড়ার আন্দোলনে বিপ্লবী হেনা দাস সবসময় স্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন।
আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী, কবি ফারহানা রহমান, গবেষক মিলটন কুমার দেব এবং কথাসাহিত্যিক ইকবাল খন্দকার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি আলতাফ হোসেন, সাজ্জাদ আরেফিন, ওমর কায়সার, ইউসুফ রেজা, আসাদ কাজল, শাহেদ কায়েস এবং সারমিন মতিন মিতু। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী কাজী মদিনা, পলি পারভীন, জালালউদ্দীন হীরা। এছাড়াও ছিল নাজিয়া জাবীনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্পর্শ ফাউন্ডেশন’, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘কথা আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র’ এবং মোঃ সজীব মিয়ার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘হাওলা’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া, সাইদুর রহমান বয়াতি, জহির আলীম, আবুল বাসার আব্বাসী এবং বশির উদ্দিন সরকার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম কুমার সরকার (তবলা), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কী-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি), খোকন বাউলা ( দোতারা) ও মেহেদী হাসান রনি (ঢোলক)। আজ ৩০শে মাঘ ১৪৩০/১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মঙ্গলবার। অমর একুশে বইমেলার ১৩তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩ টায় এবং চলবে রাত ৯ টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন হরিশংকর জলদাস এবং ফারজানা সিদ্দিকা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ফাগুনের সাজে প্রাণের বইমেলা যে পাঠকের অপেক্ষায়। খোঁপায় হলুদ গাঁদা আর লাল পলাশ গুজে লাল সাদা হলুদ পাখিরা ফাগুন কুঁড়াতে আসবে। বিকশিত হোক বইমেলার উচ্ছাস।
মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি