হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী চরিত্র ‘বদি’র পরই আব্দুল কাদের দীর্ঘদিন পরিচিত ছিলেন ইত্যাদির মামা হিসেবে। দীর্ঘ ২৫ বছর মামা-ভাগ্নে চরিত্রে রূপদানকারী এই গুণী অভিনেতা প্রসঙ্গে বলেছেন দেশবরেণ্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত।
বিষাদে বুকটা ভারী হয়ে আসে। মৃত্যু অনিবার্য জানি। তবুও আমার পরিবারের একে একে এভাবে বিদায়ের শোক আমি ঠিক নিতে পারছি না। এন্ড্রু কিশোর, নাজমুল হুদা বাচ্চু, মহিউদ্দিন বাহার, কেএস ফিরোজ, এবার গেল কাদের ভাই। কাদের ভাই আমাদের ‘ইত্যাদি’ পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। কাদের ভাইয়ের কথা কী বলবো! তার সঙ্গে তো এক-দুই বছর না, এক দুটি কাজ নয়। টানা ২৫ বছর তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন ধারাবাহিকভাবে। এমনকি তার জীবনের শেষ শুটিংও করেছেন আমার সঙ্গে। ফলে তার এই হঠাত্ চলে যাওয়া আমাদের জন্য খুবই বেদনার। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন সত্ অভিনেতা আর পরম বন্ধুকে হারালাম। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বড় ক্ষতি হলো, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিন দশকের সম্পর্ক আমাদের। প্রথমদিকে ইত্যাদিতে অনিয়মিত হলেও শেষের ২৫ বছর টানা তিনি কাজ করেছেন এই শোতে। এর পেছনে প্রধান কৃতিত্ব কিন্তু আমাদের চেয়ে ওনার বেশি। কারণ একটি চরিত্র যদি আমরা দীর্ঘসময় টেনে নিতে চাই পর্দায়, তবে সেটার জন্য ঐ শিল্পীর কমিটমেন্ট, সময়ানুবর্তিতা ও সততা প্রয়োজন পড়ে। তা না হলে এ ধরনের সিক্যুয়েল শো টানা যায় না। সেই বিবেচনায় কাদের ভাই আমার দেখা সবচেয়ে সচেতন শিল্পী, যার ওপর নিশ্চিন্তে ভরসা করা যায়। যেটা ২৫ বছর ধরে আমি পেয়েছি। তিনি লিকার চা ছাড়া কিছুই খেতেন না। তার মতো ছকে আঁকা জীবন খুব কম শিল্পীর মধ্যে দেখেছি।
আমরা শেষ শুটিং করেছি ২২ সেপ্টেম্বর। সেদিন দেখে মনে হলো, কাদের ভাই কেমন যেন শুকিয়ে গেছেন। চেহারা মলিন লাগছে। শুটিং করতে কষ্ট হচ্ছে। ডায়লগ আস্তে আস্তে বলছিলেন। তো আমি বললাম, ‘কাদের ভাই, আপনাকে আরো জোরে বলতে হবে। অডিও পাচ্ছি না।’ কাদের ভাই বললেন, ‘জোরে তো আর বলতে পারবো না।’
এই কথা শুনে আমি একটু ধাক্কা খেলাম। কারণ ২৫ বছরে কোনোদিন যার মুখে ‘না’ শুনিনি, সেই মানুষটি এভাবে বলছে কেন!
কাছে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, আপনার শরীর খারাপ? তাহলে আজ বাদ দেন। বললেন, ‘একটু খারাপ, একটু। সমস্যা নেই আমি পারবো।’ যাই হোক, কাজটা শেষ করলাম। তিনি যাওয়ার সময় সবার সামনে থেকে আমার হাত ধরে ইউনিটের বাইরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘হানিফ ভাই, আমার শরীরটা আসলেই ভালো না। আমার জন্য দোয়া কইরেন। যেন এই কাজটা নিয়মিত করতে পারি।’ ওটাই সরাসরি শেষ দেখা ও কথা আমাদের। এরপর ভেলোরে যাওয়ার পর তার ছেলের মাধ্যমে ভিডিও কলে দেখলাম। সেই দৃশ্যটা এত দ্রুত দেখবো ভাবিনি, খুব কষ্ট হয়েছে। কাদের ভাই, সেদিন খুব কেঁদেছেন বিছানায় শুয়ে। জড়ানো কণ্ঠে বলেছেন, ‘হানিফ ভাই, আমার জন্য দোয়া কইরেন। আমরা আবার একসঙ্গে কাজ করবো।’ এরপর নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছি শেষদিন পর্যন্ত। কাদের ভাইয়েরা হলেন এই ইন্ডাস্ট্রির শতভাগ খাঁটি মানুষ। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।