২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ৮:৪৮
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি / রাত ৮:৪৮

আত্মগোপনে যশোর ৪ আসনের সাবেক এমপি রণজিৎ কুমার রায়

গণঅভ্যুত্থানের পর আত্মগোপনে যশোর ৪ আসনের সাবেক এমপি রণজিৎ কুমার রায় “পড়তে পারেন দুদকের জালে ! যশোর প্রতিবেদক }=
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে অবৈধ স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন যশোরের ৪ আসনের (বাঘারপাড়ায় – অভয়নগর বসুন্দিয়া )এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য রনজিৎ কুমার রায় ও তার পরিবার । বিগত কয়েক বছর ধরে তার নিজের রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহ এলাকার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচার আছে সাবেক এই সংসদ সদস্যর অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য , দখল বানিজ্য এবং গাড়ি বাড়ির মালিক ও অঢেল সম্পদের মালিক তিনি কি ভাবে হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সংসদ সদস্য রণজিৎ কুমার রায় আওয়ামী লীগের শাসন আমলে অবৈধভাবে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এমপি হওয়ার আগে আধাপাকা টিনের ঘরে বসবাস করলেও ১৫ বছরে নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। অসংখ্য গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমির মালিক হয়েছেন তিনি। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, সরকারি বরাদ্দ লুট, জমি দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে গড়েছেন এই সব অঢেল সম্পদ। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্যও আলোচিত ছিলেন তিনি। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় যে সম্পদের হিসাব উল্লেখ করছেন, সে অনুযায়ী সাবেক এই এমপির ১৩৩ গুণ ও স্ত্রী নিয়তিরানী রায়ের ২৬৩ গুণ সম্পদ বেড়েছে বলে প্রচার হলেও বাস্তবে রণজিৎ রায় ও তাঁর স্বজনের সম্পদ বেড়েছে হাজার গুণ। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন তিনি।

এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ সাবেক এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে দুদকের সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে তেমন কোন সূত্র জানা যায়নি । গত বৃহস্পতিবার বিভিন্ন মাধ্যমে খবর টি প্রচার হওয়ার পর সাবেক এই এমপি,ও তার ছেলে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাজীব রায় এবং এমপি পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে তাদের পাওয়া যায়নি । আওয়ামী লীগের একটি অংশের দাবি অনুযায়ী

সাবেক এ এমপির অবৈধ সম্পদ অর্জনের অন্যতম মাধ্যম ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য। তিনি, তাঁর স্ত্রী নিয়তি রায় এবং দুই ছেলে রাজীব রায় ও সজীব রায় অন্তত ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। নিয়োগ বাণিজ্য নিরঙ্কুশ করার জন্যই তারা সভাপতি হন বলে অভিযোগ রয়েছে। টানা ১৫ বছর সংসদ সদস্য থাকায় একচেটিয়া নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন তিনি। ২২ লাখ টাকার বিনিময়ে বাঘারপাড়া ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে হাবুল্যা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ৩২ লাখ টাকার বিনিময়ে রায়পুর কলেজের অধ্যক্ষ, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ধলগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে আগরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ছাতিয়ানতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ২২ লাখ টাকার বিনিময়ে খাজুরা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক এবং ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে অভয়নগরের বিসিসি মুজহিদা মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ করেছেন।

শুধু এই প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়; বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলার প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে রণজিৎ কুমার রায়ের নামে মোটা অঙ্কের ঘুষ বাণিজ্য করতো ওই সব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিগন । দুই দুই উপজেলায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত ও কলেজ সরকারীকরণের নামে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন তিনি। তাঁর অবৈধ টাকা আয়ের আরেকটি উৎস ছিল টেন্ডার বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কমিশন গ্রহণ। তাঁর পক্ষে টেন্ডার ও প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্য তদারকি করতেন শ্রমিকলীগ নেতা , যুবলীগের নেতা, ও নিজের কর্মী বাহিনী দিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি জোরপূর্বক ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখলের অভিযোগ রয়েছে। বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক হাসান আলীকে (বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন এনে দেওয়ার কথা বলে ৫ বিঘা জমি তাঁর অনুসারীর নামে লিখে নেন। হাসান নির্বাচনে হেরে গেলে চাপে পড়ে সেই জমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় সাবেক এই এমপি।

বন্দবিলা ইউনিয়নের একাধিক জনপ্রতিনিধি জানান, খাজুরা শ্মশানের জমি কেনার কথা বলে হিন্দুদের কাছ থেকে এক কোটি টাকা চাঁদা তুলে ৪২ শতক জমি নিজের নামে লিখে নিয়েছেন রণজিৎ রায়। বাঘারপাড়া উপজেলার চাপাতলা গ্রামের সুশীল মল্লিক মাস্টারের ১২ বিঘা (৪৬ শতকে বিঘা) জমি জোরপূর্বক লিখে নিয়েছেন রণজিৎ রায়। ভুক্তভোগী এখনও ভয়ে পরিবারসহ এলাকাছাড়া। এ ছাড়াও ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে সরকারি ও খাসজমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে সরে দাঁড়ান। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে হলফনামায় তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল সর্বসাকল্যে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার। এর মধ্যে পৈতৃকসূত্রে পাওয়া এক লাখ টাকা মূল্যের ৪ বিঘা জমি এবং খাজুরায় ৪ শতক জমির ওপর ৫০ হাজার টাকা মূল্যের টিনের ঘর। বার্ষিক আয় এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা। তাঁর স্ত্রী নিয়তি রানীর নগদ ৭০ হাজার টাকা এবং ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫ তোলা স্বর্ণ।

১৫ বছরের ব্যবধানে এ দম্পতির সম্পদ বহু গুণে স্ফীত। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় রণজিতের ৪ কোটি ৫০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ টাকা দামের ১২ বিঘা কৃষিজমি, ঢাকার পূর্বাচলে ৩০ লাখ টাকা দামের রাজউকের প্লট, ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের দালান এবং ১০ লাখ টাকার অকৃষি জমি। বর্তমানে রণজিৎ রায়ের নিজের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে নগদ ১ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, স্থায়ী আমানত হিসেবে বিনিয়োগ (ডিপিএস) ১২ লাখ ৫১ হাজার টাকা, ২৩ লাখ টাকার জিপ গাড়ি, এক লাখ টাকার ৬০ তোলা স্বর্ণ, এক লাখ ৩০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার আসবাব।

২০২৪ সালের হলফনামায় রণজিৎ রায়ের স্ত্রী নিয়তি রানীর স্থাবর সম্পদ আছে এক কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকার তিনটি বাড়ি ও ৫০ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট, যা ২০০৮ সালে ছিল না। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রণজিতের স্ত্রী নিয়তি রানীর নামে নগদ টাকা আছে ৫১ লাখ ১৫ হাজার। ২০০৮ সালে যা ছিল ৭০ হাজার। স্থায়ী আমানত হিসেবে বিনিয়োগ আছে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। আরও আছে ৫৫ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট কার, যা আগে ছিল না। এ ছাড়া আছে ৪৫ হাজার টাকা দামের ১০ তোলা স্বর্ণ, ৪০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ১৫ হাজার টাকার আসবাব।

হলফনামায় দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপন করেছেন রণজিৎ কুমার রায়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাঁর সম্পদের চিত্র। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাঁর যশোর শহরের রেল রোডে একটি পাঁচতলা ও একটি তিনতলা রাড়ি রয়েছে। যশোরের লোহাপট্টিতে বাড়ি, নিউমার্কেটে দুটি ফ্ল্যাট, বাঘারপাড়ায় দুইতলা বাড়ি, বাঘারপাড়ার খাজুরায় চারতলা বাড়ি, ঢাকার মিরপুরে দারুস সালাম রোড়ে ২টি ফ্ল্যাট এবং দুই ছেলের নামে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত ও সল্টলেকে দুটি বাড়ি রয়েছে । যশোরের চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলায় ২২৫ একর জমি, খুলনার ফুলতলা উপজেলায় ৫০ একর জমির ওপর মাছের ঘের কিনেছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

গোপন প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এক কোটি টাকা দামের একটি পাজেরো জিপ, দুই ছেলের ৬০ লাখ টাকার প্রাইভেটকার, স্ত্রীর ৩০ লাখ টাকা মূল্যের প্রাইভেটকার ও ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০টি কাভার্ডভ্যান রয়েছে। এ ছাড়াও কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন রণজিৎ রায় ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে জেস টাওয়ার শাখার জনতা ব্যাংকের একটি লকারে রক্ষিত ২শ ভরি স্বর্ণের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন রণজিৎ রায়। ওই সময় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের মালিকানা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় ।# ১৩/৯/২০২৪ ই্্

Facebook
Twitter
LinkedIn